রাকিবুল রাকিব, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ)

  ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

‘চোখের চিকিৎসা হলে মায়ের মুখ ও পৃথিবীটা দেখতে পারতাম’

‘তহন আমার বয়স তেরো কি চৌইদ্দ। অভাবের লেইগ্যা প্রতিবন্ধী ইশকুলের লেহাপড়া ছাইর‌্যা বাড়িত আইয়্যা পড়লাম। কিন্তু আমি অন্ধ বইল্যা বাড়ির পোলাপাইন কেউ আমার লগে মিশত না, কথা কইত না। হেরলেইগ্যা একলা একলা বাড়িত বইয়্যা গান গাইতাম। একদিন বাড়ির সামনের এক দোকানে বইয়্যা ওস্তাদ শাহ আলম সরকারের বিচ্ছেদি একটা গান ধরলাম। হেই গান হুইন্যা মানুষজন আমারে খুশি হইয়্যা টেকা-পয়সা দিল। বাড়িত আইলে মা টেকা গুইন্যা কইল ‘৬০০ টেকা অইছেরে জুয়েল’। হেই থেইক্যা যে গান গাওয়া ধরলাম আর ছাড়লাম না। অহন তো বারো বৎসর ধইর‌্যা এই গান গাইয়া পেট চালাইতাছি। অভাব তো দূর হয় না। আমার চোখের চিকিৎসা করানোর টাকাও নেই। জানি না মরার আগে আল্লাহর এই সুন্দর দুনিয়াটা দেখে যেতে পারব কী না।’

কথাগুলো বলছিলেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী গানের শিল্পী মো. জুয়েল (২৬)। তার বাড়ি ময়মনসিংহ সদর থানার সিরতা ইউনিয়নের চর আনন্দীপুর গ্রামে। তিন ভাইয়ের মধ্যে জুয়েল দ্বিতীয়। গত শনিবার বিকেলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জুয়েলের দেখা মিলে গৌরীপুর পৌর শহরের ধানমহাল এলাকায়। সেখানকার সড়কের পাশে বসে তিনি প্লাস্টিকের একটি গ্যালনে লাঠির টুকরো দিয়ে আঘাত করে ছন্দ তুলে গান গাইছেন। গানের ফাঁকে ফাঁকে চাইলেন নিজের জন্য একটু সহযোগিতা। শ্রোতারাও তার ডাকে সারা দিয়ে যে যার মতো ৫-১০ টাকা করে দিয়ে সাহায্য করল তাকে।

গান শেষ হলে কিছুক্ষণ কথা হয় জুয়েলের সঙ্গে। কথায় কথায় জমে উঠে গল্প। তিনি বলেন, ‘ছোট বেলায় আমার অসুখ হইছিল। তহন গেরামের এক ডাক্তারের ওষুধ খাওনের পর থেইক্যা আমার মাথা ফুইল্যা যায়, আস্তে আস্তে আমার চোখের পাওয়ারও কইম্যা যাইতে থাহে। অহন বাম চোখে ঝাপসা দেখলেও, ডান চোখে কিছুই দেহিনা। মায়ের লগে থাকলেও জানি না তার মুখটা কেমুন। খালি স্বপ্নে দেহি মায়ের মুখটা।’

জুয়েলের বাবা মারা গেছে অনেক বছর আগে। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাই রনি ঢাকায় ভ্যান চালায়। ছোট ভাই তুহিন রংমিস্ত্রির কাজ করে। আর মাকে নিয়ে জুয়েল একা বাড়িতেই থাকে। টাঙ্গাইল জেলার একটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুলে কয়েক বছর পড়াশোনা করেছেন জুয়েল। সেখান থেকে তিনি নিজের নাম, পরিচয় ও ঠিকানা লেখা শিখেছেন। তবে গান আয়ত্ত করেছেন তিনি মোবাইলে শুনে শুনেই।

প্রতিদিন সকাল হলে বাড়ি থেকে বের হন জুয়েল। এরপর স্থানীয় হাটবাজারের ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, বাউল ও ফোক ঘরনার বিভিন্ন গান গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন তিনি। গান শুনে শ্রোতারা খুশি হয়ে যা দেয়ে তা থেকে দিন শেষে তার আয় ৪০০-৫০০ টাকা। পাশাপাশি প্রতিবন্ধী ভাতাও পান তিনি। এই টাকা দিয়েই মাকে নিয়ে অভাব-অনটনে সংসার চালান তিনি। জুয়েলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা নেমেছে। সড়কে জ্বলে উঠেছে নগর বাতি। এমন সময় কয়েকজন শ্রোতা জুয়েলের গান শুনে তাকে সামান্য কিছু টাকা দেন। তাদেরই একজন জুয়েলকে বলেন, ‘বাউল তো তুমি গান ভালোই গাও, তয়, চোখ ভালা থাকলে তো তুমি গাইয়া আরো নাম কামাইতে পারতা।’ কথার রেশ টেনে জুয়েল বলেন, নাম কামানির আমার দরকার নাই। অন্ধ বইল্যা বাবার মরা মুখটা কেমুন, দেহি নাই। খালি লাশের সামনে বইয়্যা কানছি। তয় মরার আগে নিজ চোখে মায়ের মুখটা দেহার খুব ইচ্ছা। কিন্তু আমার তো এত টেকা-পয়সা নাই যে চিকিৎসা কইর‌্যা অন্ধ চোখ ভালা কইর‌্যা মায়েরে একনজর দেখমু।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close