জিয়াউদ্দিন রাজু

  ২১ জানুয়ারি, ২০২০

আ.লীগের বিদ্রোহীরা ভোটের মাঠে

কঠোর নির্দেশের প্রতিফলন নেই

আগামী ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর পদে একক প্রার্থী নিশ্চিত করতে কেন্দ্রের ‘কঠোর নির্দেশ’ ও নানা উদ্যোগের প্রতিফলন নেই ভোটের মাঠে। দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীদের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কঠোর কোনো সিদ্ধান্তের প্রয়োগ দেখাতে পারেনি ক্ষমতাসীন দলটি। যদিও দলের সমর্থনের বাইরে এখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থেকে যাওয়া প্রার্থীদের ‘বুঝিয়ে-শুনিয়ে’ সমঝোতার চেষ্টা চলছে।

তবে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিলেও প্রকৃতপক্ষে এ বিষয়ে নমনীয় থাকার কৌশল নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম ও সাংগঠনিক সম্পাদক দুই নেতার সঙ্গে আলাপ করে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। ঢাকা মহানগরের একাধিক নেতাও এমনটা জানিয়েছেন।

সিটি করপোরেশনের বেশিরভাগ ওয়ার্ডে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা সক্রিয়। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কয়েক নেতা ও ঢাকার বিভিন্ন সংসদীয় আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ‘মদদে’ দলের মূল প্রার্থীর বিরুদ্ধে মাঠে বিদ্রোহীরা রয়েছেন। এতে দলের ভেতরের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে উঠছে বলে অভিযোগ তৃণমূলের নেতাকর্মীদের।

দলীয় সূত্র জানিয়েছে, কেউ দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বিদ্রোহী হলে তাকে দল থেকে বহিষ্কারের বিষয়েও কড়া বার্তা দিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা। এমন বাস্তবতায় দুই সিটিতে নির্বাচন পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট নেতাদের যোগাযোগকে বিদ্রোহ দমনে কাজে লাগানোর কৌশল নেওয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় এরই মধ্যে বেশকিছু ওয়ার্ডে দল সমর্থিত একক প্রার্থী নিশ্চিত করা গেছে।

এরপরও দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে দলের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে অন্তত ১১৫ নেতা এখনো সক্রিয়। ডিএসসিসির ৭৫টি সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে ৪২টিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন ৭২ জন। ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৫টিতে ৩৯ জন বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ১২৯ ওয়ার্ডের মধ্যে ৭৭টিতেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিদ্রোহী মোকাবিলা করতে হতে পারে ভোটের দিন। বিদ্রোহী প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন সাংসদপুত্রও।

প্রথমে তিন শতাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী থাকলেও গত ৯ জানুয়ারি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে অন্তত ২০০ জন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। বাকিদের মধ্যে বেশিরভাগই কোনো কেন্দ্রীয় নেতা, না হয় সংসদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তর এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কোনো কোনো শীর্ষ নেতার প্রশ্রয়েই মাঠে রয়ে গেছেন বলে তৃণমূলের ধারণা।

বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে গত শনিবার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে দলীয় বিদ্রোহীদের বিষয়টা আওয়ামী লীগের ইন্টারনাল ম্যাটার। আমরা আমাদের সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারি বা না পারি, বিষয়টা আমাদের ওপর ছেড়ে দিন না।

তিনি বলেন, আমরা ক্ষমতায় আছি ২০০৯ সাল থেকে ১১ বছর। এতে বিদ্রোহ বা স্বতন্ত্র প্রার্থী এই বিষয়গুলো থাকবেই। এত বড় দলের মধ্যে এসব সমস্যা থাকবেই। বিদ্রোহের জন্য আওয়ামী লীগ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, এমন তো না। বিএনপিরও বিদ্রোহী প্রার্থী আছে।

এদিকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে কোনো সমঝোতায়ই যেতে রাজি নন বেশ কয়েকজন বিদ্রোহী প্রার্থী। এ নিয়ে তারা সাংগঠনিক শাস্তির বিষয়টিতেও গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তারা কোনো কিছুতেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন না বলে জানান। রাজধানীর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান নাঈম এবার উত্তরের ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডে বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী। তিনি নির্বাচনী একটি সভায় জনসাধারণের সামনে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের এক হাইকমান্ডের নাম জড়িয়ে বলেন, আমাকে কেন্দ্রীয় ওই নেতা বলেছে নির্বাচন করতে। এলাকার জনসাধারণ চায় আমি নির্বাচন করি। আমিও কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ করেই স্বতন্ত্র নির্বাচন করছি।

এ বিষয়ে জানতে নাঈমকে প্রতিদিনের সংবাদ থেকে ফোন করা হয়। তবে ফোন পেয়ে তিনি লাইন কেটে দেন বেশ কয়েকবার।

অন্যদিকে উত্তর আওয়ামী লীগের এক এমপি দলীয় প্রার্থীর বাহিরে বিএনপির এক প্রার্থীর (ভাতিজার) হয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তিনি এবারই প্রথম এমপি হয়েছেন। এর আগে তিনি মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদে ছিলেন।

আরেক অনুসন্ধানে জানা গেছে, ‘ক্যাসিনো সাঈদ’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ও নানা অভিযোগে অপসারিত কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে ডিএসসিসির ৯ নম্বর ওয়ার্ডে এবার ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’। দল থেকে মনোনয়ন না পেয়ে তার বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার পেছনেও এক মন্ত্রীর ‘মদদ’ রয়েছে বলে ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) যুবলীগের কয়েক নেতাকর্মীর অভিযোগ।

আরেক দিকে ঢাকা-৭ আসনের আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমও এবার ডিএসসিসির ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে ‘বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী’। এ ওয়ার্ডে একসময় হাজী সেলিম কমিশনার ছিলেন। বাবার ওয়ার্ডে দলের মনোনয়ন না পেয়ে ইরফান ‘বিদ্রোহী’ হওয়ায় নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা ক্ষোভ আছে।

কেন্দ্রের নির্দেশে হাজী সেলিম যেখানে দলের একক প্রার্থী নিশ্চিতে কাজ করার কথা, সেখানে তার ছেলে বিদ্রোহী হওয়ায় নানা আলোচনা চলছে নেতাকর্মীদের মধ্যে। এবার ওই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর মোহাম্মদ হাসান তিল্লু, যিনি হাজী সেলিমের ভাগিনা।

এদিকে সিটি নির্বাচনের আগের দিন রাতেও বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে সমাঝোতার চেষ্টা চলবে বলে প্রতিদিনের সংবাদকে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি বলেন, অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে দল করছেন। সংগঠনকে শক্তিশালী করতে তাদের অবদান রয়েছে। ফলে হুট করে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত না নিয়ে আমরা সমঝোতার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আশা করি বিদ্রোহীরা থাকবে না।

এর বাহিরে এবারের নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হলে তার বিরুদ্ধে ‘কঠোর সাংগঠনিক’ ব্যবস্থা কী হতে পারে, তাকে একটা নির্দিষ্ট সময়, নাকি আজীবনের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করা হবে—এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শিগগিরই আসবে বলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক সূত্র জানায়।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নির্দেশ,বিদ্রোহী,আওয়ামী লীগ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close