শাকিল আহমেদ, ঠাকুরগাঁও

  ০৭ অক্টোবর, ২০১৮

নির্বাচনী হাওয়া : ঠাকুরগাঁও-৩ আসন

বহুদলীয় লড়াই ছাড় দিতে কেউ রাজি নয়

বহুদলীয় লড়াইয়ের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে ঠাকুরগাঁও-৩ আসন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তৎপর হয়ে উঠেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও ওয়ার্কার্স পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। আসনটি নিজেদের দখলে নিতে মরিয়া প্রতিটি দলের নেতারা। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়।

পীরগঞ্জ উপজেলা ও রানীশংকৈল উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের ৫ নম্বর এই আসন। স্বাধীনতার পর থেকে আওয়ামী লীগের দখলে থাকলেও জোট রাজনীতির কারণে দলটির সমর্থনে কখনো জাতীয় পার্টি, কখনো ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। মহাজোটের সমীকরণে আগামী নির্বাচনেও মনোনয়নের জন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কার্যত লড়াই হবে শরিক দলের নেতাদের। অন্যদিকে বিএনপি এ আসনে কখনোই জয়ী হতে পারেনি। তবুও আশা ছাড়েনি দলটি। এখন পর্যন্ত দলের একজন নেতাকে মাঠে তৎপর থাকতে দেখা যাচ্ছে।

এদিকে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ও রানীশংকৈল উপজেলার সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সেলিনা জাহান লিটা, জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ইমদাদুল হক ও রানীশংকৈল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক সহিদুল হক। তবে বিগত দিনের প্রার্থিতার ইতিহাস বেশ করুণ।

২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য ইমদাদুল হককে পরাজিত করেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী হাফিজ উদ্দীন আহম্মদ। তখন থেকেই আসনটি হাতছাড়া হয় আওয়ামী লীগের। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান সাবেক সংসদ সদস্য ইমদাদুল হক, জাতীয় পার্টি থেকে হাফিজ উদ্দীন আহম্মদ এবং ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে সাবেক সংসদ সদস্য শহীদুল্লাহ শহীদ। কিন্তু আসনটি মহাজোটের রাজনীতিতে শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থীকে ছেড়ে দেওয়ায় কেন্দ্রের নির্দেশে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী। নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে ওই নির্বাচনে বিএনপিকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন মহাজোটের জাতীয় পার্টির প্রার্থী হাফিজ উদ্দীন আহম্মদ। তবে বিএনপির প্রার্থী জাহিদুর রহমান অন্যবারের চেয়ে সেবার প্রায় ছয় গুণ ভোট পেয়েছিলেন।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবারো আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চান ইমদাদুল হক, জাতীয় পার্টি থেকে হাফিজ উদ্দীন আহম্মদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে অধ্যাপক ইয়াসিন আলী। কেন্দ্রের নির্দেশনায় এবারও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন আ.লীগ প্রার্থী ইমদাদুল। নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় জাতীয় পার্টির হাফিজ উদ্দীনের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ান ওয়ার্কার্স পার্টির ইয়াসিন আলী। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা সমর্থন দেওয়ায় মহাজোটের শরিক দল হিসেবে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী জয়লাভ করেন।

এ বছর আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ইমদাদুল হক আবারো দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এই আসনটিতে দীর্ঘদিন ধরে যোগ্য প্রার্থী না থাকায় এলাকার তেমন উন্নয়ন হচ্ছে না। তাই আওয়ামী লীগের হাতকে আরো শক্তিশালী ও এলাকার উন্নয়ন করতে সাধারণ মানুষ তাকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চায়। তিনি প্রার্থী হলে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবেন বলেও আশাবাদী ইমদাদুল হক।

গত জয়ের স্বাদ নিয়ে মাঠে বসে নেই ওয়ার্কার্স পার্টির বর্তমান সংসদ সদস্য ইয়াসিন আলী। যদিও তার বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের রয়েছে নানা অভিযোগ। দলটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন নেতা প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বর্তমান ওয়ার্কার্স পার্টির এমপি ইয়াসিন আলী স্থানীয় আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে এলাকার উন্নয়ন কর্মকা- করেন। তিনি নিয়োগ বাণিজ্য করে এবং বিভিন্ন সরকারি বরাদ্দের টাকার ভাগ নিচ্ছেন। নিজের আখের গোছাতে তিনি আওয়ামী লীগের ক্ষতি করে যাচ্ছেন।

স্থানীয়রা জানান, ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে ইয়াসিন আলী ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে এমপি নির্বাচিত হয়েছে। কিন্তু এলাকায় দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন নেই। এমপি নিজের পকেট ভরতে ব্যস্ত থাকেন; তাই এলাকার জনগণ এমন একজন এমপি চান যার দ্বারা এলাকার উন্নয়ন হবে।

অভিযোগের বিষয়ে সংসদ সদস্য ইয়াসিন আলী অস্বীকার করে বলেন, সততার সঙ্গে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। এজন্য ক্ষমতাসীন দলের অনেক প্রভাবশালী নেতা ব্যক্তিগতভাবে সুবিধা করতে না পেরে তার নামে বিভিন্নভাবে কুৎসা রটাচ্ছেন।

ইয়াসিন আলী বলেন, তিনি সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকে এলাকার উন্নয়নে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আগে থেকেই তিনি খুব স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন। এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নে সাধারণ মানুষের পাশে থেকে সহযোগিতা করে আসছেন।

১৯৮০ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সে সময় তিনি দীর্ঘদিন ছাত্র ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৮২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। বর্তমানে তিনি ওয়ার্কার্স পার্টির ঠাকুরগাঁও জেলা কমিটির সভাপতি। ইয়াসিন আলী বলেন, তিনি সাধারণ মানুষের পাশেই রয়েছেন এবং তাদের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। আগামীতে দলীয়ভাবে মনোনয়ন পেলে তিনি আবারও বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবেন বলে আশা করছেন।

অন্যদিকে এ আসনটিতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে তেমন দলীয় কোন্দল ও বিভেদ না থাকায় সাংগঠনিক অবস্থান বেশ মজবুত। সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে অনেক আগে থেকেই মাঠ গুছিয়ে রেখেছে দলটি।

দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী বর্তমান সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য সেলিনা জাহান লিটা বলেন, তিনি ১৯৮৬ সাল থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদে রয়েছেন। এখন পর্যন্ত তিনি দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ কাজ করে যাচ্ছেন। ২০১৪ সালে বিপুল সমর্থন নিয়ে তিনি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর একই সময় তিনি ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য হন। তিনি নিজ এলাকায় দলকে সুসংগঠিত করে রেখেছেন। সাধারণ মানুষের বিপদে-আপদে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করে আসছেন। আর এ কারণেই নিজ দলের নেতাকর্মী ও এলাকার সাধারণ মানুষের সমর্থনে আগামী সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন তিনি।

সেলিনা জাহান লিটা আরো বলেন, তার বাবা প্রয়াত আলী আকবর ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগের একজন আদর্শবান, সৎ ও বঙ্গবন্ধুর একান্ত বিশ্বস্ত ছিলেন। এছাড়া ২০০১ সাল থেকে এই আসনে আওয়ামী লীগের কোনো দলীয় সংসদ সদস্য না থাকায় নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। এতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ও সরকারদলীয় সংসদ সদস্য না থাকায় এলাকার উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আর বর্তমানে যিনি সংসদ সদস্য তিনি বিশেষ একটা পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই নির্বাচিত হয়েছেন। জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি রাজনীতিতে একেবারেই নতুন। তাকে দিয়ে এলাকার উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই সব দিক বিবেচনা করে এবার তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে মনোনয়ন চাইবেন।

অন্যদিকে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী জাহিদুর রহমান জাহিদকে মাঠে তৎপর থাকতে দেখা যাচ্ছে। দলীয় কর্মীদের নিয়ে চায়ের দোকানে আড্ডা থেকে শুরু করে এলাকার বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে তাকে।

জাহিদুর রহমান জাহিদ বলেন, তিনি পীরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি। অনেক কষ্ট করে এই উপজেলায় তিনি দলকে সুসংগঠিত করে রেখেছেন। তৃণমূলের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ এবার তার হয়ে নির্বাচন করবে। গ্রামে অনেক ভোট রয়েছে বিএনপির। বিএনপি থেকে তিনি মনোনয়ন পেলে এবার এ আসনে দলের বিজয় সুনিশ্চিত। তাই তিনি দলের মহাসচিবের কাছে মনোনয়ন চাইবেন।

এদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে এবার একটু আগে থেকেই দলকে সুসংগঠিত ও কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে গণসংযোগ করছেন জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য হাফিজ উদ্দীন আহম্মদ। এবার তিনি এ আসনে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন।

হাফিজ উদ্দীন আহম্মদ বলেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় পার্টির জন্য নিবেদিত প্রাণ। দলের ও সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করে আসছেন তিনি। সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় তিনি তার এ নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও এ অঞ্চলের মানুষ তাকে অত্যন্ত ভালোবাসে। এ আসনে তিনি জাতীয় পার্টির হয়ে নির্বাচিত হলে আবারও এ এলাকার শিক্ষা, কৃষি, চিকিৎসাসহ সবক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হবে বলে হাফিজ উদ্দীন আহম্মদ দাবি করেন।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ঠাকুরগাঁও,ঠাকুরগাঁও ৩ আসন,নির্বাচনী হাওয়া,জাতীয় সংসদ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close