মো. মাজহারুল ইসলাম রবিন, ঢাবি শিক্ষার্থী

  ২০ আগস্ট, ২০১৮

আর্টস পড়ে কী করবা?

আমাদের দেশে তো অনেক সংস্কৃতিই আছে, যা নিয়ে আমরা গর্ব করি। গর্ব করার বাইরেও আরো কিছু বিষয়, যা এখন সংস্কৃতির পর্যায়ে চলে গেছে। ঠিক সংস্কৃতিও বলবোনা। এটা এক ধরণের অবসেশনের পর্যায়ে চলে গেছে। তা হলো Aim in Life। এর সহজ বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘জীবনের লক্ষ্য’। হাই স্কুলে থাকতে Aim in Life নিয়ে আমরা অনেক রচনা, অনুচ্ছেদ রচনাও করেছি যা সম্পূর্ণ বইয়ের কথা। হয় ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার অথবা শিক্ষক। এর বাইরে আর কিছুই লেখা থাকতো না। ভাবটা এমন যে, এর বাইরে যেনো আর কোনো প্রফেশনই নেই। আমাদের পরিবার থেকে শুরু সমাজের সবার একটাই ধারণা পৃথিবীতে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া আর কোনো পেশাই নেই, এগুলো ছাড়া অন্য কিছু হলে জীবনটা বিফলে যাবে, না খেয়ে মরতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি কথা বার্তা।

ছোটবেলা থেকে মোটামুটি ভালো ছাত্র হওয়ার কারণে সবাই ধরেই নিয়েছিলো যে আমি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবো বড় হলে অর্থাৎ হাই স্কুলে গ্রুপ নির্ণয় করার সময় সায়েন্স নিয়েই পড়াশোনা করবো এমন একটা প্রেডিকশন ছিলো সবার। ক্লাস এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ার পর যেনো আগুনে ঘি পড়ে। সাইন্স না নিয়ে পড়লে যেনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে, মৃত্যুদণ্ড হওয়ার মতো অপরাধ হবে।

আমি ছোটবেলা থেকেই গণিত আর সাধারণ বিজ্ঞানে কাঁচা । এই দুই বিষয়ে এমন অবস্থা ছিলো যে, স্যার কি পড়াতো তা মাথার উপর দিয়ে যেতো। তবে সামাজিক বিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি এই সকল বিষয় আমাকে টানতো । জেএসসি এবং এসএসসি পরীক্ষায় অংক না বুঝে মুখস্ত করে পরীক্ষা দেয়ার মতো বিরল রেকর্ডও আমার দখলে।

তো যাই হোক, ক্লাস নাইনে সকলকে আশাহত করে মানবিক বিভাগ নিলাম অধ্যয়নের জন্যে। সকলের আশাভঙ্গ হওয়ার পর তাদের মুখের এক্সপ্রেশনটা দেখে মনে হতো আমি তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে পারমাণবিক বোমা ফেলেছি। যে শোনে, সে-ই আমাকে আমার ভুলের কথা মনে করিয়ে দেয় এবং মানবিকে পড়ে যে আমার কোনো ভবিষ্যত নেই, তা আমাকে কড়া ভাষায় জানিয়ে দেয়। এই তালিকায় আমার পাড়াপড়শি থেকে শুরু করে শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধব কেউই বাদ যাননি।

একদিনের একটা ঘটনা বলি, তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। একদিন আমার পাশের বাড়ির দুঃসম্পর্কেও এক বড় ভাই, যিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় নয়বার ফেল করেছেন বলে লোকশ্রুতি আছে, তিনি আমাকে আর আমার আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তুমি আর্টস নিছো??!!! (তাচ্ছিল্যের সুরে) জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিছো। তোমার মতো ভালো ছাত্ররা সাইন্সে পড়বে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবে। আর্টস পড়ে তুমি কি করবা?’ এই বলে তিনি তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করে চলে গেলেন। ততক্ষণে আম্মু রেগে আগুন। পরবর্তীতে আমার সাথে কি হয়েছিল সেটা না হয় নাই বললাম।

শিক্ষকদের কাছ থেকেও যে, খুব একটা কম কথা শুনেছি তা কিন্তু নয়। একদিন এক বিজ্ঞানের শিক্ষক আমাকে আর্টস পড়ে যে কোনো ভবিষ্যত নেই, সেই বিষয়ে আমাকে সুন্দর একটা লেকচার দিলেন। তবে তিনি সায়েন্স পড়ে কি করেছেন? এই প্রশ্ন মাথায় এলেও প্রশ্নটা গিলে ফেলি।

সহপাঠীদের মধ্যে যারা সায়েন্স নিয়েছিলো তারা নিজেদের এলিট ক্লাস মনে করা শুরু করলো আর আমি তখন ফকির ক্লাসের সভাপতি। এমনকি যারা বিজ্ঞানের আ-কার ও বোঝেনা, তারাও নিজেদের জাতে তোলার জন্যে সায়েন্স নিলো। পরে তারা কি করেছে সেইটা না হয় নাই বললাম।

আমি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ি। যেই ভাইয়ের কথা উল্লেখ করেছিলাম, তিনি কোনো এক অজানা কারণে আমাকে এড়িয়ে চলেন, কথা বলেন না। আমার সেই বিজ্ঞানের শিক্ষকও এখন সায়েন্সে পড়ার গুণগত মান নিয়ে গবেষণাধর্মী বক্তব্য দেন না।

এইটা যদি আপনারা মোটিভেশনাল স্পিচ মনে করেন, তাহলে আপনারা ভুল। আর্টস নিয়ে পড়ার সমস্যা দুর হলেও, এখন বিষয় নিয়ে নতুন সমস্যার উদ্ভব ঘটেছে। এবার বিতর্কের বিষয় সাংবাদিকতায় পড়ে, সাংবাদিক হয়ে আমি কি করবো? আলগা পিরিতের মানুষগুলোর কপালে চিন্তার ছাপ। একদিন আমার এলাকার এক চাচা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমি কোথায় পড়ি। বললাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। তিনি লম্বা করে ‘ও........’ বললেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি নাকি ঢাকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি এর মধ্যে কোনটা বুঝলেন আমি জানিনা। সাংবাদিকতা নিয়ে পড়ি শুনে, এই বিষয়ে পড়ে যে আমার কোনোই ভবিষ্যত নেই, এই সামাজিক বার্তাটা দিয়ে তিনিও তার সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করলেন। এমনকি আমার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে অনেকে এই বলেও মন্তব্য করেন যে, আমি আর্টস নিয়ে পড়েছি বিধায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি। মনে হয় যেন, আর্টস নিয়ে পড়লেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া যায়, পড়াশোনা করা লাগেনা।

আমাদের দেশে সায়েন্স আর কমার্সকে উঁচু শ্রেণীর বিষয় মনে করা হয়। আর যাদের কোনো উপায় নেই তারাই শুধু আর্টস নেয়। আমি সায়েন্স বা কমার্সের সমালোচনা করছিনা। নিঃসন্দেহে এই দুইটি বিষয় নিজ নিজ জায়গায় অনেক গুরুত্ব বহন করে। তবে আর্টস শুধু নিরুপায়ের শেষ ভরসা না, এইটাও সায়েন্স, কমার্সের মত সমান গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ।

সব মানুষ এক না। মানুষ যেমন আলাদা, তেমনি তাদের মেধা-মনন ও আগ্রহও আলাদা। যার যেইদিকে দক্ষতা বেশি, তাকে সেইদিকে পথ দেখান, নিজের পছন্দের দিকে জোর করে নয়।

পিডিএসও/রিহাব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আর্টস,কী,করবা,পড়
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close