এ এফ এম ফৌজি চৌধুরী
স্মরণ
একটি দিবসে বাংলাদেশ
আজ ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। জাতির ইতিহাসে এক বেদনাবিধুর দিন। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের সুপরিকল্পিত চক্রান্তে নির্মমভাবে নিহত হন দেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীরা। নিহতদের মধ্যে ছিলেন সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী, মেধাবী, পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাসহ অসংখ্য পন্ডিত ব্যক্তিত্ব।
মেধাবী নিরীহ এ মানুষগুলো ছিলেন জাতির বাতিঘরের মতো। নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার বুদ্ধিজীবীরা পরাধীনতার দিনগুলোতে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মৌলিক, মানবাধিকারসহ ন্যায়নীতি আইনের শাসনের ব্যাপারে ছিলেন সোচ্চার। সংকীর্ণ রাজনীতির গলিতে আবদ্ধ না থেকে জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জাতির সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। নির্মোহ এসব বুদ্ধিজীবীর শূন্যতা আজও অপূরণীয় রয়ে গেছে। আজকের শোকাবহ এ দিনটিতে মনে রাখতে হবে, শহীদ বুদ্ধিজীবীরা জাতির অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশই নয়, অনুপ্রেরণার উৎসও বটে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস কেবল পালন করাটাই যথেষ্ট হতে পারে না। এদের লালিত স্বপ্ন-আদর্শ ধারণের মধ্যেই দিবসটি যথোপযুক্ত মর্যাদা পেতে পারে। হতে পারে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি যথাযথ সম্মান এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপকরণ। আমাদের ব্যর্থতা রয়েছে। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করতে পারিনি আমরা। সঠিক গবেষণা ও তদন্তের মাধ্যমে শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার পূর্ণাঙ্গ ছবি উদ্ধারে আমরা এখনো সফলতার দাবিদার হতে পারিনি। বুদ্ধিজীবীদের কে কোথায় কিভাবে শহীদ হয়েছেন তারও কোনো কিনারা হয়নি। নিহত বুদ্ধিজীবীদের অনেকের পরিবারও জানতে পারেনি প্রিয় মানুষটির লাশ কোথায় কোন বধ্যভূমিতে ঘুমিয়ে আছে!
দায়সারা গোছের বুদ্ধিজীবী দিবস উদযাপন বা দিবসটি রাজনীতিকীকরণের লেভেল এঁটে উদ্যাপনের দৈন্য থেকে আমরা এখনো বেরিয়ে আসতে পারিনি। বুদ্ধিজীবীদের আত্মদানকে অর্থবহ করে তুলতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। শহীদ বুদ্ধিজীবীরা দেশ-জাতির অহংকারের একটি অংশ। কোনো দল বা গোষ্ঠীর নয়। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং বীর শহীদদের প্রত্যাশা থেকে ক্রমশ আমরা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছি। বুদ্ধিজীবীদের প্রত্যাশিত গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক মুক্তির চূড়ান্ত ফলে আমরা পৌঁছাতে পারিনি।
যদিও আমরা স্বধীনতার ৪৫টি বছর পার করেছি। স্বাধীন দেশে আজও গণতন্ত্রের জন্য জীবন দিতে হচ্ছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তান আমলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিপীড়ন-নির্যাতন সয়েও প্রতিবাদ করেছেন। তাদের প্রতিবাদের ফসলই হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং আমাদের স্বাধীনতা। অত্যন্ত নির্মম হলেও সত্য, তাদের কাক্সিক্ষত সেই স্বপ্ন এখনো আমরা পূরণ করতে পারিনি। স্বাধীন দেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য যেখানে কমার কথা ছিল, তা না হয়ে বৈষম্যের পরিমাণ ক্রমশই বেড়েছে।
দুর্বৃত্তায়নের অর্থনীতির জাঁতাকলে দেশের মেহনতি মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। মানবতা-মানবিকতা, নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দেশাত্মবোধ লালনে তৎকালীন বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন আপসহীন। বিজাতীয় সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতা মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়, বিভাজনের তাঁবেদারির রাজনীতির বিরুদ্ধে সবসময়ই তারা ছিলেন সোচ্চার। শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আত্মমর্যাদা, স্বাজাত্যবোধ, দেশপ্রেমের যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় নেই বললেই চলে। বৈষম্যহীন অর্থনীতি, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, মানবাধিকার-মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবে। দেশের জন্য যারা জীবনোৎসর্গ করেন তারা বীর। বীররা জীবনোৎসর্গ করেন পরবর্তী প্রজন্মের সুখ ও শান্তির জন্য। এটাই বীরদের চাওয়া-পাওয়া।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চাওয়া-পাওয়া কোনো কাল্পনিক এবং বায়বীয় ছিল না। তাদের চাওয়ার মধ্যে ছিল একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ আর সে দেশের জন্য শোষণমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং ন্যায়বিচার। যার কোনোটাই এখনো পূর্ণ মর্যাদায় ভূষিত হতে পারেনি। আমরা মনে করি, এ সমাজ ব্যবস্থা যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতাও থাকবে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের দিনটিতে জীবনোৎসর্গকারী বুদ্ধিজীবীদের লালিত স্বপ্ন হৃদয়ঙ্গম করার মধ্য দিয়েই খুলতে পারে অর্থনৈতিক মুক্তির সেই লালিত স্বপ্ন। ফরমায়েশী বা ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীদের উপদ্রবের এ সময় নিঃস্বার্থ, নিখাদ, দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জীবনাদর্শ, চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণায় অনুসরণ নতুন প্রজন্মের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গঠনে তাদের মেধা-মনন আত্মত্যাগের প্রতিফলন আবশ্যক। আজকের এই দিনে আমরা কি তাদের আত্মার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে বলতে পারি না, ‘তোমাদের স্বপ্ন আমরা পূরণ করবই’।
লেখক : কলামিস্ট
পিডিএসও/তাজ