মাহবুবুল আলম

  ২১ আগস্ট, ২০১৭

২১ আগস্ট হামলার কুশীলব

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে ২১ আগস্ট ২০০৪ ইতিহাসের বর্বরোচিত যে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ছিল, সে হামলার পেছনে যে হাওয়া ভবনের দুর্দান্ত প্রতাপশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি তারেক রহমান ও তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সরাসরি হাত ছিল, তা বিভিন্ন তদন্ত রিপোর্টে বেরিয়ে এসেছে। তাদের নির্দেশেই বিশেষ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে মামলার সব আলামত নষ্ট করে—এটা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে হয়েছে বলে তারা প্রচার করে। মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য নোয়াখালীর নিরীহ জজ মিয়ার পরিবারকে আজীবন ভরণপোষণের লোভ দেখিয়ে সিআইডি জোর করে জজ মিয়া থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করেছিল।

এ মামলা বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে কূটকৌশলে এক রকম ধামাচাপা দেওয়ার ব্যবস্থাই করা হয়েছিল। কিন্তু বিধি বাম ২০০৬ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করে এবং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে তিন-চতুর্থাংশ মেজরিটি নিয়ে মহাজোট ক্ষমতায় এসে মামলাটি পুনর্তদন্তের ব্যবস্থা করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে থাকে। এ মামলায় বিএনপি-জামায়াত জোটের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস ছালাম পিন্টু ও হরকাতুল জেহাদ নেতা মুফতি হান্নানসহ অনেককেই সিআইডির একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে যে, হামলা থেকে শুরু করে সব ছিল হাওয়া ভবন ও তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নখদর্পণে। আলামত গায়েবের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের ওপর। তিনি সিআইডির কর্মকর্তাদের আজীবন সুবিধা দেওয়ার নিশ্চয়তাসহ পদোন্নতি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে কব্জা করেন। এই অ্যাসাইনমেন্ট বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে সিআইডির সাবেক এসপি মুন্সি আতিকুর রহমান ও এএসপি আব্দুর রশীদের ওপর।

হাওয়া ভবনে শেখ হাসিনা কিলিং মিশনের যে বৈঠক হয়েছিল মুফতি হান্নানের সেই বিষয়ক সাক্ষাৎকারটি ওয়েবসাইটে দেখলে যে কেউ আতঙ্কে শিউরে ওঠবেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের ‘প্রোর্ট্রেট অব জিহাদ’ প্রামাণ্য চিত্রে মুফতি হান্নানের (ফাঁসিতে দন্ডিত) এ লোমহর্ষক সাক্ষাৎকারটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ওই সাক্ষাৎকারে মুফতি হান্নান শেখ হাসিনার কিলিং মিশনের গ্রেনেড হামলার আদ্যপান্ত বর্ণনা করেছেন। ওই প্রামাণ্যচিত্রে হরকাতুল জেহাদ নেতা হান্নান বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনামলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের অঘোষিত যুবরাজের হাওয়া ভবনে বসে হামলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় বলে উল্লেখ করেন। ওই সভায় জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ (যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিতে দণ্ডিত), তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি নূর চৌধুরীসহ আরো কয়েকজন জঙ্গি নেতার উপস্থিতির কথাও তিনি বলেছেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অপারেশনাল কমান্ডার মুফতি হান্নান হাওয়া ভবনে বৈঠক হওয়া থেকে শুরু করে জিয়াপুত্র তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি মেজর নূর জড়িত থাকার চাঞ্চল্যকর তথ্য সাক্ষাৎকারে প্রকাশ করেছেন। মুফতি হান্নান তার জবানবন্দিতে বলেন, হামলার মূল পরিকল্পনাই ছিল শেখ হাসিনাকে নিশ্চিহ্ন করা। যার পরিকল্পনায় ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি খুনি নূর চৌধুরী এবং তারেক জিয়া নিজে। চারটি গোপন বৈঠকের মাধ্যমেই ২১ আগস্ট হামলার পুরো চক্রান্ত করা হয় হাওয়া ভবনে বসেই। ১৪ আগস্ট হাওয়া ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তিনটি প্রস্তাবের একটিকে অনুসরণ করে চালানো হয় মূল হামলা। ওই জবানবন্দিতে হান্নান ফাঁস করে দেয় এ হামলায় হাওয়া ভবনের সংশ্লিষ্টতার কথা।

শেখ হাসিনা বেঁচে যাওয়ায় তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় বলে শেখ হাসিনা কিলিং মিশনের অপারেশনাল কমান্ডার মুফতি হান্নান ওই জবানবন্দিমূলক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘হামলার সময়ে আমি আমাদের দারুল আরকান অফিসে ছিলাম। হামলার আগের দিন শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই তাজউদ্দীন, হরকাতুল জিহাদ নেতা আবু তাহের জান্দাল ও কাজলের কাছে ১৫টি গ্রেনেড দেন। অর্থ ও জনবল দিয়ে সব ধরনের সাহায্য করার ওয়াদাও তিনি করেছিলেন। সকালে অফিসে ব্রিফিংয়ের পর একটি কালো ব্যাগে গ্রেনেডগুলো দুপুর ১২টায় টার্গেটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। হঠাৎ করেই ভ্রাম্যমাণ স্টেজ হওয়ায় তাদের পরিকল্পনায় অনেকটাই বাধা পড়ে। অত্যধিক ভিড়ের কারণে হামলাকারীরা টার্গেটের ধারে কাছে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়। সেসময় জনসভার দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে হামলাকারীরা অবস্থান নেয় এবং জামায়াতের সক্রিয় ১৫ জন সদস্য হামলায় অংশ নেয় বলে হান্নান বলেন। প্রচন্ড ভিড়ের কারণেই কারো সঙ্গে কারো যোগাযোগ রক্ষায় সমস্যা হচ্ছিল। এরই মধ্যে দক্ষিণ দিকে হঠাৎই একটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফেলায় যে যার মতো করে গ্রেনেডগুলো ওপরের দিকে ছুড়ে মারতে শুরু করে, ফলে প্রায় সব গ্রেনেডই ওপরে ফেটে যায়। তার বর্ণনা মতে; ২০ থেকে ৩০টি গ্রেনেড মানুষকে সঠিকভাবে আঘাত করতে পারেনি। সেগুলো ওপরেই বিস্ফোরিত হয়েছিল। একই সঙ্গে রাইফেলের গুলি চালালেও হাসিনার কোনো সমস্যা হয়নি বলে তখনই আমরা জানতে পারি।’

ইতিহাসের এই ভয়াবহ ও নারকীয় হত্যাকাণ্ডের নানা ধরনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন জনকন্ঠ, ডেইলি স্টার, সমকাল, যুগান্তর, প্রথম আলোসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রপত্রিকার রিপোর্টে ইতিহাসের সবচেয়ে কাপুরুষোচিত এই গ্রেনেড হামলায় যে হাওয়া ভবন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যাবতীয় কলকাঠি নাড়া হয়েছে, তা প্রকাশিত হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও বিশেষ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিচালিত নারকীয় এ হামলার বিষয়টি পুরোপুরিই মনিটর করেছিল হাওয়া ভবন। এই মনিটরিংয়ের ধারাবাহিকতায়ও হাওয়া ভবনের মধ্যস্থতায় পাকিস্তান থেকে শতাধিক আর্জেস গ্রেনেড আনার কাজে সহায়তা করে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই।

হাওয়া ভবনে কারা, কিভাবে এ হত্যাযজ্ঞের নীলনকশা প্রণয়ন করেছিল; তা নিয়ে ২৭ অক্টোবর ২০১০ ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদনের প্রতিবেদক লিখেছেন, গ্রেনেড হামলা ও হত্যা মামলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তা, হুজির বিভিন্ন সূত্র, গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বক্তব্য এবং জিজ্ঞাসাবাদে মামলার আসামিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এ হামলা পরিকল্পনার ব্যাপারে একটি অত্যন্ত গোপনীয় ফাইল সংবাদপত্রটির কাছে রয়েছে বলেও দাবি করা হয়েছে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশ কয়েকটি বৈঠকের ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ১৪ আগস্ট হাওয়া ভবনে আলোচনায় বসেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদস সালাম পিন্টু, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে জড়িত খুনিদের একজন, জামায়াতের এক শীর্ষ নেতা, জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জেহাদের আল ইসলামীর দুই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, জঙ্গি সংগঠন আল মারকাজুল ইসলামীর এক নেতা এবং হাওয়া ভবনের শীর্ষ এক ব্যক্তি। সেদিনই শেখ হাসিনাকে হত্যার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন তারা। পরদিন ১৫ আগস্ট একই জায়গায় আবার বৈঠকে বসেন তারা।

এ চাঞ্চল্যকর মামলাটি সিআইডির অতিরিক্ত এসপি আবদুল কাহার আখন্দ তদন্ত করেন এবং সে অনুযায়ী চার্জশিট দেওয়া হয়। চার্জশিটে তারেক জিয়া, বাবরসহ বিএনপি-জামায়াত এবং হুজি নেতা মুফতি হান্নানসহ সিআইটির সাবেক দুই ডিজিকে আসামি করা হয়েছে। সেই চার্জশিট অনুয়ায়ী বর্তমানে ২১ আগস্ট লোমহর্ষক গ্রেনেড হামলার বিচারিক কাজ চলছে। আশা করা যায় অতিদ্রুত বিচারকাজ সম্পন্ন করার মাধ্যমে এ নারকীয় হত্যাকাণ্ডে প্রকাশ্যে ও নেপথ্যে জড়িত সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে এবং ২১ আগস্ট পৈশাচিক গ্রেনেড হামলা মামলার রায় বাস্তবায়ন করে বুঝিয়ে দিতে হবে ষড়যন্ত্রকারীদের ইতিহাস কোনো দিন ক্ষমা করেনি, কোনো দিন ক্ষমা করবেও না।

লেখক : কলামিস্ট

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
২১ আগস্ট হামলা,মতামত,কলাম
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist