এস এম মুকুল

  ২২ মে, ২০১৭

সমাজের আয়না

স্টোরি অব এ রেইনট্রি

বৃষ্টি বৃক্ষ। নামকরণের এমন সার্থকতা খুঁজে পাওয়া ভার। ‘রেইনট্রি’ বৃষ্টি ঝরাতে না পারলেও অসংখ্য নারীর চোখের পানি যে ঝরিয়েছে সে কথা বলা যায়। আর সে কারণেই বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আজ উচ্চারিত হচ্ছে ঘৃণিত এই বৃষ্টি বৃক্ষের নাম। দ্য রেইনট্রি। রাজধানী ঢাকার একটি আবাসিক হোটেলের নাম। যেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা বন্ধুদের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে ২০০৮ সালে ধর্ষণ হয়েছে ৪৫৪টি, ২০০৯ সালে ৪৫৬টি, ২০১০ সালে ৫৯৩টি, ২০১১ সালে ৬৩৫টি, ২০১২ সালে ৭৭২টি, ২০১৩ সালে ৫৭৩টি, ২০১৪ সালে ৫৫৬টি, ২০১৫ সালে ১০৬৯টি এবং ২০১৬ সালে ১০৬০টি। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ধর্ষিতাদের মধ্যে রয়েছে ১৮ বছরের কম ৮ শতাংশ, ১৮-২৫ বছরের মধ্যে ৪৫ শতাংশ, ২৫-৩৫ বছরের মধ্যে ২১ শতাংশ, ৩৬-৫০ বছরের মধ্যে ১৮ শতাংশ এবং ৫০ ঊর্ধ্ব ৮ শতাংশ। এসব ধর্ষণ ঘটনার পরও অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী নীরব দর্শকের ভূমিকা নেয়। অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ রয়েছে, থানায় ধর্ষণ মামলা নিতে গড়িমসি করা হয়। অর্থ আর ক্ষমতায় প্রভাবিত হয়ে আইনশৃঙ্খলার স্বাভাবিক গতিধারা শিথিল হয়ে পড়ার প্রতিচিত্র ফুটে ওঠে প্রতিটি ধর্ষণ ঘটনায়। যথাসময়ে যথাযোগ্য শাস্তি প্রদানে বিলম্ব হওয়াই ধর্ষণ ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সমাজ বিশ্লেষকরা। ধর্ষণ সভ্য সমাজের মানসিক অবক্ষয়ের একটি প্রতিচ্ছবি।

আধুনিকতার নামে, সভ্যতার নামে, সচেতনতার নামে সমাজ জীবন যত উন্নততর হচ্ছে একের পর এক ধর্ষণ আর গণধর্ষণের খবর ততই বাড়ছে। সভ্যতার ভেতরে বর্বরতা আর বিকারগ্রস্থতার অসুখ ততই ছড়িয়ে পড়ছে। প্রশ্ন জাগে, আমরা কী সত্যিই সভ্য হচ্ছি নাকি অসভ্যতা আমাদের মাঝে নানাভাবে জাগ্রত হচ্ছে? ধর্ষকের জামিনে বের হয়ে আসা, মামলার দীর্ঘসূত্রতা, অনেক ক্ষেত্রে মামলা না করার প্রবণতা, আইনি দুর্বলতা ও শাস্তি ছাড়াই স্থানীয়ভাবে মীমাংসা হওয়া—এসব কারণের পাশাপাশি মূল্যবোধের অবক্ষয়, অসুস্থ যৌন লালসা বিশেষভাবে ধর্ষণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন। রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত ‘দ্য রেইনট্রি’ আবাসিক হোটেলটির নাম সারা দেশের মানুষ জানল একটি ধর্ষণাচারের কাহিনির মাধ্যমে। এর আগে হলি আর্টিজানকে দেশের মানুষ চিনেছিল জঙ্গি হামলার মাধ্যমে। তার মানে রাজধানীর অভিজাত হোটেলগুলোয় সভ্যতার অন্তরালে কি বীভৎস অসভ্য কার্যকলাপ চলে তা সহজেই অনুমেয়। বলতে অবশ্য কোনো দ্বিধা নেই যে, মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় সবচেয়ে বেশি অসভ্য বর্বরতার অনুঘটক তথাকথিত উচ্চবিত্ত সমাজের বাসিন্দারা। ক্ষমতা, অর্থ আর প্রাচুর্যতা এই উচ্চবিত্ত সমাজের মাঝে যে আগ্রাসী মনোভাব তৈরি করেছে তারই প্রতিফলন দ্য রেইনট্রি হোটেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী (বান্ধবী) ধর্ষণের ঘটনা। প্রাচুর্যতা উচ্চবিত্ত সমাজকে মানব সমাজের মানবিকতা ও মূল্যবোধ থেকে ক্রমশ দূরে সরিয়ে নিচ্ছে তাদের লোভ, বিলাস আর বেপরোয়া দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। এই বখে যাওয়া উচ্চবিত্ত সমাজের পিতারা তাদের সন্তানদের সুশিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়ে অর্থের আশকারায় বখাটে বানাচ্ছেন। আর এসব উচ্চবিত্ত বণিক পিতারা তাদের সন্তানকে যখন মেধায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে ব্যর্থ হন তখনই তারা আভিজাত্যের অহমিকায় মরিয়া হয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছেন এমন উদাহরণও আছে আমাদের সমাজে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াটা যত না সহজ, তার চেয়ে অধিকতর সহজ নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা পাওয়া। আজকের দিনে সেসব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের খেরোখাতা খুলে দেখলে তারই প্রমাণ মিলবে। সহজেই বলা যায়, এসব সন্তান দেশ আর সমাজকে আর কীইবা দিতে পারে! তাই বলে উচ্চবিত্ত সমাজে ভালো সন্তান, পিতা, পরিবার নেই—এ কথা ঢালাওভাবে সত্য নয়।

শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বলা যাচ্ছে না যে, ধর্ষিতা মেয়ে দুটি কেন রাতের বেলায় এমন পার্টিতে গেল। তাদের পরিবার বা অভিভাবকরা কি সেটা জানত না? এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েরাইবা কেন এত অসচেতন থাকবে, তাও বোধগম্য নয়। যাই হোক, ধর্ষণ একটি বড় মাপের অপরাধ। গোটা বিশ্বে ধর্ষণ এমন এক ঘটনা, যার অধিকাংশ খবর প্রকাশ পায় না। সামাজিক সম্মানের খাতিরে গোপন রাখা হয়। এক পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি তিনজনের একজন ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। বিস্ময়কর খবর হলো, আঠারো বছরের পূর্বে আমেরিকায় ৪০ শতাংশ নারী ধর্ষিত হলেও ৬৮ শতাংশ ধর্ষণের কোনো রিপোর্ট হয় না। আরো ন্যক্কারজনক খবরটি হলো, সেখানে কারাগারেও নাকি বছরে ২ লাখ ১৬ হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হয়। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে প্রতিদিন ২০০ জন ধর্ষিত হয়। দক্ষিণ আফ্রিকাতে বছরে পাঁচ লাখ নারী ধর্ষিত হয়। ভারতে প্রতি ২০ মিনিটে একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। কানাডাতে ৮০ শতাংশ ধর্ষণ হয় আত্মীয়ের দ্বারা। এসব পরিসংখ্যান কোনো অবস্থাতেই প্রমাণ করে না ধর্ষণ গ্রহণযোগ্য বা বাংলাদেশে এর মাত্রা কম। বরং বিচার না হওয়া, বিচারের আওতায় সামাজিক কারণে না যাওয়ায় ধর্ষণ হার ও প্রবণতা যে কেবলই বাড়ছে তারই নমুনামাত্র।

মজার ব্যাপারটি হলো, ধর্ষক যারা তারাও মনুষ্য সমাজে বাস করে। তাদেরও বোন, কন্যা, স্ত্রী, মা নিয়ে পরিবার ও স্বজন রয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটলে তারা কি মেনে নিতে পারত? খবরে প্রকাশ, সাফাত আহমেদ দম্ভোক্তি করে বলে বেড়িয়েছে, ‘আমার বাপ সোনা বেচে। দুই-একটারে কাইটা ভাসায়া দিলে কেউ টের পাইব না। প্রশাসন আমার কিছুই করতে পারবে না। আমার বাবার কোটি কোটি টাকা আছে। প্রয়োজনে বাবা ১০০ কোটি টাকা দিয়ে হলেও এই ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে দেবে।’ তার দম্ভোক্তি অস্বাভাবিক নয়। যার পিতা দম্ভোক্তি করে বলে, ‘আরে মিয়া, আমার পোলা আকাম (ধর্ষণ) করছে তো কি হইছে। জোয়ান পোলা একটু-আধটু তো এসব করবই। আমিও তো করি।’ একজন পিতার এমন দম্ভোক্তিই প্রমাণ করে তার সন্তানের লাম্পট্য সীমা কোন মাত্রায় পৌঁছেছে। আর তার চারিত্রিক অবস্থান কোন জায়গায় অবস্থান করছে। আপন জুয়েলার্সকে মানুষ আপন করে নিলেও এমন লাম্পট্যপনা আর টাকার বাহাদুরি সহ্য করবে না এদেশের জনগণ। কথাটি বোধহয় আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ বুঝতে পারেননি। টাকার জোরে ক্ষমতার সাহচর্যে অনেক কিছু থেকে পার পাওয়া গেলেও সবকিছু থেকে পার পাওয়া যায় না। অবশ্য এ কথা এখন সরকারের প্রশাসন যন্ত্রকেই প্রমাণ করতে হবে। একজন শিল্পপতি প্রকাশ্যে প্রশাসনকে তাচ্ছিল্য করার যে স্পর্ধা দেখিয়েছে, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে প্রশাসনকে প্রমাণ করতে হবে টাকা আর ক্ষমতার কাছে প্রশাসন কোনোভাবেই দুর্বল নয়। দিলদার আহমেদ সম্পর্কে তার সাবেক পুত্রবধূ ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা মিডিয়াকে বলেছেন, ‘দিলদার আহমেদ সেলিম একটা প্রথম সারির লম্পট। পিতার লাম্পট্যের কারণেই পুত্র সাফাত নষ্ট হয়েছে।’ বাপ হয়ে ছেলের চরিত্র নষ্ট করার কিংবা লম্পট পিতার ধর্ষক সন্তান হওয়ার কারণ এখন দ্য রেইনট্রি। দিলদারের সন্তান সাফাতের দৈনিক খরচ দুই লাখ টাকা বা তারও বেশি! প্রতিদিন নারী ও নেশার জলসা এমন পিতার সন্তান করবে নাতো কে করবে? সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বনানীর রেইনট্রি হোটেল বন্ধ ও আপন জুয়েলার্স বর্জন এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি নিয়ে রব ওঠায় ধর্ষকদের ধরে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। অন্যথায় এ ঘটনাও নিশ্চিতভাবে তনু হত্যার মামলাকে অনুসরণ করত। তবে, এখনো নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে, মামলাটি ন্যায়বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।

লেখক : বিশ্লেষক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist