আবু তাহের

  ২৫ মার্চ, ২০১৭

বোধ

সুখী মানুষের গল্প

১.

সুখী মানুষের গল্পটা প্রায় সবাই জানেন। গল্পটা এ রকম-এক রাজার ভীষণ অসুখ হলো। বহু চিকিৎসক, বৈদ্য, হেকিম, ওঝা দেখানো হলো। কেউই রোগ সারাতে পারছেন না। অবশেষে একজন চিকিৎসক এসে রাজাকে ভালোভাবে দেখে বললেন, রাজাকে সুস্থ করা যাবে। তবে উপায় হলো একজন সত্যিকারের সুখী মানুষের জামা লাগবে। সে জামা গায়ে দিলে রাজা সুস্থ হয়ে উঠবেন। সেনাপতি তার পাইক পেয়াদা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন সুখী মানুষের খোঁজে। এক সুদর্শনকে চোখে পড়ল। তার শারীরিক সৌন্দর্য দেখলে যে কেউ মুগ্ধ হবে। তারা ভাবল এ ব্যক্তিই সত্যিকারের সুখী। কিন্তু তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল যে, সে মানসিকভাবে বেশ বিপর্যস্ত। তার মতে, তার চাইতে দুখী কেউ নেই। সেনাপতি হতাশ হয়ে নতুন কারো সন্ধান করতে লাগলেন। একজন বিত্তশালীকে দেখে তার সঙ্গে আলাপ করতেই তার যত দুঃখ কষ্ট বেরিয়ে এলো। এভাবে বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে ক্লান্ত সেনাপতি নদীর ধারে চলে এলেন। সেখানে দেখলেন এক লোক বেশ আনন্দ করছে। তাকে জিজ্ঞেস করলেন তার বাড়ি কোথায়, সে জবাব দিল এই নদীর ধারেই আমার বাড়ি ঘর। জিজ্ঞেস করা হলো, ঘর বিছানা কোথায়? সে বলল, এই যে ছায়াদার গাছ, প্রয়োজন হলে এখানে ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ি। তার প্রতি কথায় হাসি আর আনন্দ। তার কাছে জানতে চাওয়া হলো, সে কী খায়? সে বলল গাছের ফল, নদীর জল, যখন যা পাই তাই খাই। সেটা নিয়ে আমার কোন ভাবনা-চিন্তা নেই। বোঝা গেল যে সে সুখী মানুষ। তখন সেনাপতি বললেন, তোমার জামাটি আমাদের দিতে হবে। সেজন্য তোমাকে কত স্বর্ণমুদ্রা দেব? সুখী মানুষটি জবাব দিল, সাহেব আমার তো কোনো জামা নেই।

২.

আমাদের দেশ বিশ্বের সুখী দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে। স্থান এমনি এমনি হয়নি। জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত ১৫৫টি দেশ নিয়ে জাতিসংঘ এই জরিপটি করে। তাই আমরাও এর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু তালিকায় আমাদের অবস্থান কোথায়? ১৫৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১০-এ। জাতিসংঘের ২০ মার্চ আন্তর্জাতিক সুখ দিবস উপলক্ষে প্রকাশ করা রিপোর্ট অনুযায়ী আমরা শেষের সারির সুখী দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান ৮০তম স্থানে থেকে সবচেয়ে সুখী এবং ভারত ১২২তম স্থানে। সবচেয়ে অসুখী ১৪১তম স্থানে থাকা আফগানিস্তান। এই রিপোর্ট অনুযায়ী, নরওয়ের সঙ্গে ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড এবং ফিনল্যান্ড তালিকার প্রথম পাঁচটি স্থানে আছে।

জাতিসংঘের রিপোর্ট তৈরির প্রক্রিয়ার একটি অংশ এমন, তারা প্রতিবছর ১৫০টি দেশে ১,০০০-এরও বেশি মানুষকে একটি সোজা ও আপেক্ষিক প্রশ্ন করে। প্রশ্নটি হলো- ‘একটি মই কল্পনা করুন, যার সিঁড়িগুলো শূন্য থেকে ১০ পর্যন্ত নম্বর দেওয়া আছে। মইয়ের সবচেয়ে উঁচু সিঁড়িটি আপনার জন্য সব সম্ভাব্য সবচেয়ে সুখকর জীবন আর মইয়ের সবচেয়ে নিচের সিঁড়িটি আপনার জন্য সবচেয়ে খারাপ জীবন। আপনার মতে আপনি এই মুহূর্তে মইয়ের কোন সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন?’ তবে রিপোর্টটির মূল বিষয় হলো, আর্থ-সামাজিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করা, অর্থনৈতিক শক্তি (দেশজ সম্পদ), সামাজিক নিরাপত্তা, গড় আয়ু, ব্যক্তি স্বাধীনতা, দুর্নীতি নিয়ে ধারণা।

যেহেতু ১০০ কোটার ওপারে আমরা চলে গেছি, তাহলে আমাদেরকে তেমন সুখী দেশের নাগরিক বলা যাবে না। আমরা অসুখী। আমাদের দেশ সমৃদ্ধির দিকে যাচ্ছে, উন্নত থেকে উন্নতর হচ্ছে তবুও আমরা অসুখী। কিন্তু কেন? একটা ছোট উদাহরণ হতে পারে। নাগরিক যানজট একটা নৈমিত্তিক বিষয়। জনজীবন অতিষ্ঠ। আমাদের নাগরিক সুবিধার কথা চিন্তা করে বিপুল অর্থ ব্যয় করে তৈরি করা হলো ফ্লাইওভার। আমরা তখন আগের তুলনায় বেশি অর্থ ব্যয় করে ফ্লাইওভার দিয়ে যাতায়াত করি একটু শান্তির জন্য, সুখের জন্য। কিন্তু যদি পরিস্থিতি এমন হয়, ফ্লাইওভারের ওপর যানজটে পড়ে থাকতে হয়। তখন অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় আমাদের গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দেয়। তখন সুখ হয়তো আর লাগবে না। ফ্লাইওভারের নিচের কথা না হয় বাদই দিলাম।

৩.

গ্রেগরি পেরেলম্যান। একজন রাশিয়ান গণিতবিদ। গণিতে পোয়েনকেয়ার কনজেকচার নামে এক জটিল সমস্যা ছিল ১৯০৪ থেকে। পেরেলম্যান একশ’ বছরের পুরনো এই জটিল সমস্যার সমাধান করে ফেললেন। গণিতের এই সমস্যাটি ছিল সাতটি অন্যতম জটিল সমস্যার একটি, যার সমাধানের জন্য আমেরিকা ক্লে ফাউন্ডেশন এক মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে বসে।

২০০৬ সালে তাকে গণিতের সর্বোচ্চ পুরস্কার ফিল্ডস মেডেল দেওয়া হলো। তিনি নিলেন না। আন্তর্জাতিক গণিত ইউনিয়নের সভাপতি দেখা করতে গেলেন তার সঙ্গে। দু’দিনে দশ ঘণ্টা তাকে বোঝালেন। তবুও তিনি নিলেন না। তার জবাব ছিল এই- ‘আমাকে তিনি তিনটি উপায় বলেছিলেন, এক. আসো এবং গ্রহণ কর, দুই. এসো না কিন্তু গ্রহণ কর, আমরা মেডেল পাঠিয়ে দেব, তিন. গ্রহণ না করা। প্রথম থেকেই আমি বলে আসছি আমি তৃতীয়টা বেছে নিয়েছি। পুরস্কার আমার জন্য পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক। সবাই এটা বুঝতে পেরেছে যে, সমাধান যদি সঠিক হয় তাহলে আলাদা স্বীকৃতির দরকার নেই।’

তারপরও ক্লে ফাউন্ডেশন তাকে পুরস্কারের অর্থ দিতে চাইল। লোক এলো তার দরজায়। কড়া নাড়ল। পেরেলম্যান দরজা পুরোপুরি না খুলে ভেতর থেকেই জানিয়ে দিলেন, ‘আমার যা দরকার তার সবই আমার আছে।’

সুখী মানুষের জামা থাকে না। পেরেলম্যানও ছিলেন সেরকম। তিনি সুখী মানুষদের একজন। তারও অতিরিক্ত কিছুর প্রয়োজন ছিল না। অর্থ, বৈভব, সম্মান, প্রতিপত্তি কোনো কিছুর না। তার প্রতিবেশীদের বক্তব্য এমন- পেরেলম্যানের ঘরে জিনিসপত্রের সংখ্যা অতি নগণ্য।

আমাদের জামা লাগে, লাগে অর্থ কড়ি, সম্মান। দেশের ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়, তার বিচার হয় না। মন্ত্রীদের গাড়ি থেকে টাকার বস্তা উদ্ধার হয়, তারও বিচার হয় না। সাগর-রুনির মতো সাংবাদিক খুন হয়, তারও বিচার হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কলম ছেড়ে পিস্তল হাতে গুলি করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ইলিয়াস আলীরা কখনোই উদ্ধার হয় না। আমাদের নেতারা আমাদের কথা না ভেবে নিজেদের কথাই বেশি ভাবেন।

আর আমাদের নিজেদের অবস্থাও একই রকম। একটা গাড়িকে দুটো করার প্রবণতা, হতে পারে সেটা কোটি টাকা দামের। দুটো বাড়িকে তিনটি করার জন্য আমরা যারপরনাই ব্যস্ত। এতে আমরা যেকোনো কিছু করতে দ্বিধা করি না। মানুষকে বিপদে ফেলে নিজ স্বার্থ হাতিয়ে নেওয়ার প্রবণতা সংক্রামিত হচ্ছে দ্রুত। এতে রাষ্ট্রের দায়ও অনেক। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল লোকেরাই এর বিভিন্ন পথ দেখিয়ে দিচ্ছে। উত্তরাধিকার সূত্রে সবাই রপ্ত করছে বিষয়গুলো। আমাদের সামাজিক সম্পর্কেরও ছেদ ঘটছে মারাত্মকরূপে। পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হচ্ছে অহরহ। আর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া এসে পড়ছে সন্তানের ওপর। আমাদের সন্তান বিপদগামী হচ্ছে।

সামাজের বিভিন্ন ফাঁকফোকর গলিয়ে তারা ভয়ঙ্কর সব নেশায় অভ্যস্ত হচ্ছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের কতিপয় নেতার হাত ধরেই আসছে নেশার দ্রব্য। আমাদের সুখ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে আমরাই সুখ হারিয়ে ফেলছি স্বেচ্ছায়।

৪.

সুখী মানুষের জামা যেহেতু ছিল না, সেহেতু রাজাও সম্ভবত জামা গায়ে দিতে পারেননি। সুখী মানুষের জামা থাকে না, এজন্য হয়ত আমরাও গায়ে চড়াতে পারি না। তাই আমরাও এখন অসুস্থ। অসুস্থ আমাদের সমাজ। দিন বাড়ছে, বাড়ছে প্রতিযোগিতা, ক্ষমতার প্রতিযোগিতা। জাতিসংঘের রিপোর্ট বাদই দিলাম। আজ আমরা নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কিত। আমাদের জীবনযাত্রার মান বাড়ছে। ব্যক্তি স্বাধীনতা লুণ্ঠিত হচ্ছে। ধনী আর ক্ষমতাবানদের ক্ষমতার ঝনঝনানিতে কম্পিত আমাদের চারপাশ। আমাদের সুখ হারিয়ে যাচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে কেড়েও নেওয়া হচ্ছে। তবু আমরা স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখে বাঁচতে চাই।

লেখক : শিশু সাহিত্যিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সুখী মানুষ,গল্প
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist