রিহাব মাহমুদ

  ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

এসো হে, আমার বসন্ত এসো...

দিন-পঞ্জিকার হিসেবে ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন আজ। পহেলা ফাল্গুন। শুভ বসন্ত। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ভাষায়-“ফুল ফুটুক আর না ফুটুক, আজ বসন্ত”। তাই নানা আয়োজনে ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করে নিতে চারিদিকে ধ্বনিত হচ্ছে-“ আজি দখিন দুয়ার খোলা, এসো হে, এসো হে, এসো হে, আমার বসন্ত এসো......”।

ঋতু বৈচিত্রের দেশ আমাদের বাংলাদেশ। বার মাসে ছয়টি ঋতু এদেশে ঘুরে-ফিরে আবর্তিত হয়। এই ষড়ঋতুর আবর্তনে এ দেশটি এতটাই প্রভাবিত যে, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয় এ দেশের প্রাকৃতিক সুষমা, পারিপার্শ্বিক বাতাবরণ, মানুষসহ অন্য জীবসকলের আচার-আচরণ, দৈনন্দিন জীবন-যাপনের রীতি-বৈশিষ্ট্য, এমনকি সমাজ ও সংস্কৃতি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন- বসন্ত এলো এলো এলারে, পঞ্চম স্বরে কোকিল কুহুরে, মুহু মুহু কুহু কুহু তানে, মাধবী নিকুঞ্জে পুঞ্জে পুঞ্জে, ভ্রমর গুঞ্জে গুঞ্জে গুনগুন গানে।

ষড়ঋতুর মধ্যে সবচেয়ে জৌলুসময় ঋতু হচ্ছে বসন্ত। বর্ণ-বৈভবের বিপুল সমারোহের কারণে বসন্তকে বলা হয় ‘ঋতুরাজ’। রূপ-রসের ঝাঁপি নিয়ে এসে আমাদের মাঝে হাজির হয় এ বসন্ত। বসন্তের রূপে-গুণে কেবল মানুষই নয়, পাখ-পাখালিসহ অন্য সব প্রাণীও উল্লসিত ও উদ্ভাসিত হয় দারুণভাবে। চারিদিকে ধ্বনিত হয় - “আহা আজি এ বসন্তে/ এত ফুল ফোটে/ এত পাখি গায়/ আহা আজি এ বসন্তে...”।

ঋতুচক্রের আবর্তনে বাংলাদেশে শীতের পরেই আসে ঋতুরাজ বসন্ত। শীতের আলস্য কেটে ফাল্গুন আর চৈত্রকে ধারণ করে আগমন করে ঋতুরাজ বসন্ত। এই ঋতুই সবচেয়ে মনোরম ও সৌন্দর্যের ঋতু বলে সকলের কাছে প্রিয়। তাই এ দেশের মানুষ বসন্তের আগমনের প্রতীক্ষায় থাকে। ফাল্গুনের প্রথম দিনটিতে নানা আয়োজনে বরণ করে নেয় ঋতুরাজ বসন্তকে। এই দিনটি বাঙালির জীবনের আরেক উৎসবের দিন, মহামিলনের দিন। বসন্তের আগমনে বাঙালির জীবনে লাগে উৎসবের ছোঁয়া। তরুণ-তরুণীরা বাসন্তী রঙে ও পোশাকে সাজে। মানুষের মনে রং লাগে, জাগে প্রাণের ছোঁয়া। তাই বসন্তের গানে-কবিতায় মুখরিত হয়ে ওঠে বাংলার প্রান্তর। বসন্তের দখিনা বাতাসে শরীর জুড়ায়, পাখির কণ্ঠের মধুর গান আমাদের চেতনাকে করে সজীব। এ ঋতুতে আমগাছ মুকুলিত হয়। মৌ মৌ সুবাসে মুখরিত হয় চারিদিক। কবিগুরুর ভাষায় -“ওমা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে...”।

বসন্ত যৌবনের, সৌন্দর্যের ও আনন্দের ঋতু। বসন্তে শিমুলের শাঁখে শাঁখে রঙের আলপনা, দখিনা বাতাসে পুষ্পের ঘ্রাণ, কোকিলের কণ্ঠে প্রাণ মাতানো সুরে শীতের শীর্ণ প্রকৃতি সহসাই জেগে ওঠে। পত্র-শূন্য বৃক্ষশাখায় সবুজ পল্লবের সমারোহ দেখা যায়। শীতের শেষে বসন্তের আবির্ভাব বলেই ঘটে তার রাজকীয় অভ্যর্থনা। ঝিমিয়ে পড়া প্রকৃতিতে সে জাগিয়ে তোলে প্রাণের শিহরণ, রিক্ত শাখায় ফুটিয়ে তোলে পুষ্প-পল্লব। এ সময়ে গাছে গাছে নানা রঙের ফুল ফোটে। বিশেষ করে অশোক, পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া বসন্তের ফুল। এরা প্রকৃতির বুকে রঙ ছড়ায়। অশোক-পলাশ-শিমুল-কৃষ্ণচূড়ার রঙিন উল্লাসে কবি গেয়ে ওঠেন- “মহুয়ার মালা গলে কে তুমি এলে/ নয়ন ভুলানো রূপে কে তুমি এলে।”

ফাগুনে পলাশ, শিমুল আর কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙ যেমন আমাদের মাতিয়ে তোলে, তেমনি আমাদের মনে করিয়ে দেয় আরেক ফাল্গুনের রক্তাক্ত স্মৃতি- ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে শহীদের রক্তের ইতিহাস। মনে করিয়ে দেয় রফিক সালাম জব্বার বরকতের নাম। যাদের রক্তে এসেছিল একুশে ফেব্রুয়ারি, মুক্তি পেয়েছিল বাংলা ভাষা। এই রক্ত বুনেছিল স্বাধীনতার বীজ। আর সেই স্বাধীনতা ও মুক্তির যে যুদ্ধ তার শুরুর দিনগুলোই ছিল ফাল্গুনের।

বসন্তের আগমনের সাথে সাথে কৃষিনির্ভর গ্রাম-বাংলার প্রকৃতিতে যেন দিন বদলের হাওয়া লেগে যায়। এ সময়ে কৃষকেরা নতুন ফসলের বীজ বোনে- সমৃদ্ধ আগামীর প্রত্যাশায়। প্রতিটি মানুষ যেন তার নিজ নিজ অবস্থানে থেকে এক কর্মমুখর ব্যস্ততার মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকে। তাদের এ ব্যস্ততার সময় যে তাদের কাছে বড়ই আনন্দের তা বুঝা যায় তাদের মনের ফুর্তি দেখে, কত সমাদরে তারা যে এই সময় টাকে বরণ করে নেয়। কাজের সময় তারা বিভিন্ন রকমের গান গায় ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, পল্লিগীতি, জারি-সারি সহ আরও নানা ধরনের গান।

বসন্তের প্রকৃতি শুধু যে মধুর ও মোলায়েম তা নয়, অনেক সময় তা রুক্ষ ও কঠিন হয়ে ওঠে। বসন্তে মাঠ থাকে রিক্ত, আকাশ থাকে নির্মেঘ। চৈত্রের আকাশে আগুন ঝরে। কালবৈশাখীর নগ্ন-নৃত্য এ সময়ে জীবনকে তছনছ করে দিয়ে যায়। নদীর জলধারা ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে যায়। বসন্ত শুষ্ক ঋতু, বর্ষায় ভিজে ও শীতের শীতার্ত মাটি বসন্তে শুষ্ক হয়ে ওঠে। এ ঋতুতে মানুষ নানারকম রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। কলেরা, বসন্ত প্রভৃতি মারাত্মক রোগগুলো আনন্দের মাঝে নিরানন্দের ছায়াপাত করে। কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে বসন্তের বর্ণিল রূপ-ঐশ্বর্য বাংলার প্রকৃতি এবং মানুষের জীবন ও সংস্কৃতিতে নতুন প্রাণের স্পন্দন জাগায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে বসন্তই সেরা। ফলে, ফুলে ও পাখির গান নিয়ে বাংলাদেশের বসন্ত সব দিক থেকে সেরা ঋতু। তাই এ ঋতুকে যথার্থই ‘ঋতুরাজ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

লেখক : সাংবাদিক।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
এসো হে,আমার বসন্ত এসো
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist