অলোক আচার্য

  ০৯ জানুয়ারি, ২০২০

অহেতুক প্রাণগুলো ঝরে যায়

কয়েক দিন আগে পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো। পাস-ফেলের হিসাব নেওয়া হচ্ছে। কোথায় কতজন পাস, কতজন ফেল করেছে, তা বের করা হয়েছে। পাসের হার ছেলে না মেয়েদের বেশি, তাও নির্ণয় করা হয়েছে। এবারও ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে। কয়েক বছর ধরেই এ ফলাফল রয়েছে। দুই পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে কেউ পাস করেছে আবার কেউ ফেল করেছে। এটাই নিয়ম। কেউ পাস নাও করতে পারে।

জেএসসি পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ায় বা ফেল করায় এবং বার্ষিক পরীক্ষায় ফেল করায় দেশে এ পর্যন্ত গণমাধ্যমে ৯ জনের আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেছে। ফেল করে সামাজিক অবস্থায় তাদের লজ্জাষ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। অনেকে এটা সামাল দিতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কিন্তু কেন? আত্মহত্যা কেন? একবার ফেল করলেই কি জীবনের সব শেষ হয়ে যায়? এত তুচ্ছ এ জীবন! এটা ঠিক যে, পরীক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যই ছিল একটা ভালো ফল করা। সেটা না হলে মন খারাপ হওয়ারই কথা। কিন্তু তার থেকেও আমার মনে আশঙ্কা থাকে প্রায় প্রতিবারই পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর কারো কারো আত্মহননের খবর পত্রিকায় পড়তে হয়। এটা সত্যি অত্যন্ত দুঃখজনক। সহ্য করা যায় না। কেবল ফেল করার কারণে একজন আত্মহত্যা করবে! জীবনটা তো অনেক বড়। সমস্যাটা হলো ফল প্রকাশের পর অনেক অভিভাবকও সহানুভূতি সম্পূর্ণ আচরণ করে না। এমনকি তার প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকেও তার জন্য বিরূপ আচরণ পেয়ে থাকে।

এই ফল প্রকাশ হওয়ার পর একজন অভিভাবককে চিনি, যার সন্তান জিপিএ ফাইভ পায়নি। সামান্য পয়েন্ট কম পেয়েছে। এতে দেখলাম তিনি যারপরনাই হতাশ। তার মতে, ভবিষ্যতের একটা দিক নাকি তার মেয়ের নষ্ট হয়ে গেছে! এই হলো অবস্থা। প্রতিযোগিতা ভালো। তবে তা জীবনের বিনিময়ে অবশ্যই নয়। ফল খারাপ হয়েছে তবে ভালো করার সুযোগও তো আছে। সবাই চাই, কেবল পাসের হারে বৃদ্ধি না বরং মেধার হারে বৃদ্ধি ঘটুক। মেধাবী শিক্ষার্থী যাচাইয়ে যদি পাসের হার কমে তাহলে একটুও আফসোস নেই। কারণ কয়েকজন নামমাত্র শিক্ষিত বেকার যুবকের চেয়ে একজন প্রকৃত মেধাবী দরকার। কারণ সেই একজন বাকিদের কাজের ক্ষেত্র তৈরিতে ভূমিকা রাখে। তাই পাসের হারের কারণে মেধার সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে বলেই মনে হয়। সৃজনশীল পদ্ধতির জটিলতার কারণে বছর দুয়েক আগেও গণিতের ফলাফলে খারাপ হওয়ার কারণে সার্বিক ফল একটু খারাপ হওয়ায় হইচই পড়ে গিয়েছিল। বিষয়টা এমন যেন সবাইকে পাস করতে হবে। ফেল করা যেন মহা-অপরাধ। আর তাইতো ফল প্রকাশের পরপরই দেশে কয়েকটি আত্মহননের খবর চোখে পড়েছে। এটা একেবারে অনাকাক্সিক্ষত। সফলতা এবং ব্যর্থতা জীবনের এই দুটি দিক গ্রহণের মানসিকতা থাকা উচিত। প্রকৃতপক্ষে সঠিক মূল্যায়ন বলতে সেই পরিমাপ কতটা সঠিক তা বলা যায় না। কারণ আজকাল বিভিন্ন পদ্ধতি বারবার পরিবর্তন করা হয়। এ প্লাসপ্রাপ্তদের সংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তা বেশির ভাগের চোখেই ছিল সন্দেহের দৃষ্টিতে। তাই এ পরিবর্তনটা জরুরি ছিল। এ প্লাস শিক্ষার্থীদের সেই আই অ্যাম জিপিএ ফাইভ মার্কা আলোচনা-সমালোচনা আজও মনে আছে। ভিত্তি যদি দুর্বল হয়, তাহলে ওপরের অংশ নড়বড়ে হবেই।

একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস সঠিক কতজন শিক্ষার্থী বলতে পারবে? যদিও প্রাথমিক থেকেই তাদের জানার কথা। কিন্তু আদৌ সবাই জানে কি? আমাদের জাতীয় দিবসগুলো সম্পর্কে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সব শিক্ষার্থী জানে কি? বইয়ের বাইরে এরা আসলে বেশি শিখছে না। পরীক্ষা মানে পাস আর ফেল। যারা পাস করছে, তারা নিঃসন্দেহে মেধাবী। কিন্তু যারা পাস করছে না, তারা কি মেধাশূন্য? কোনো একটা বা দুটা বিষয়ে ফেল করলেই কি তার মেধা নেই বলা যেতে পারে? শুধু ফলাফল দিয়ে নিশ্চয়ই কোনো ছাত্রছাত্রীর মেধা পরীক্ষা করা যায় না। কারণ স্কুল-কলেজের পাস ফেল শুধু সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেক উদাহরণ আছে, যেখানে স্কুলে ছাত্র হিসেবে খুব খারাপ হয়ে পরবর্তী জীবনে বড় বড় ব্যক্তির কাতারে নাম লিখিয়েছেন এবং এই সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়। তাহলে পাস-ফেল এবং মেধা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হলেও স¤পূর্ণ নির্ভর নয়। যে শিক্ষা মানুষের ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে না, তার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আজকাল যেন সেই মূল লক্ষ্য কেবল সার্টিফিকেট। কোনোমতে একটা সার্টিফিকেট পেলেই সব শেষ। তারপর এদিক-সেদিক ধরাধরি করে একটা চাকরি বাগিয়ে সমাজে দিব্বি মেধাবী সেজে ঘুরে বেড়ানো যায়। একসময় দেশে পরীক্ষায় নকল করার একটা প্রবণতা ছিল। তখন পাসের হারও কম ছিল। কিন্তু সবাই নকল করতে পারত না। তবে আশ্চর্যের বিষয় কিন্তু সেটা নয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেসময় পরীক্ষার কেন্দ্রে অসদুপায় অবলম্বন করলেও শিক্ষার্থীদের মেধা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলত না। কে পরীক্ষার কেন্দ্রে নকল করেছে, সে বিষয়টার সাক্ষী কেবল আরেক পরীক্ষার্থী থেকে যেত। আজ কেন্দ্রের সামনে লেখা থাকে নকলমুক্ত পরীক্ষা কেন্দ্র। তবে শিক্ষার্থীদের মেধা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় কেন?

কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ফেল করলেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। বরং অন্য কোনো বিষয়ে তার আগ্রহ আছে ধরে নিতে হবে। কোনো নির্দিষ্ট পরীক্ষায় ফেল বা কম মার্ক পেলেই জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করে মনুষ্যত্ব অর্জনে। আর তাই যারা পরীক্ষায় ফেল করেছে বা আশানুরূপ ফল করতে পারেনি তারা যেন সব শেষ হয়ে গেছে—এটা মনে না করে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সঙ্গ দিতে পারে সন্তানের অভিভাবক। যেসব কলেজে কোনো শিক্ষার্থীই পাস করতে পারেনি; সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ভবিষ্যতে মেধাবী কেউ বের হবে না; সে গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না। তবে পাস না করার কারণ খতিয়ে দেখা দরকার। কর্তৃপক্ষের গাফিলতি প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নিতে হবে। দক্ষ জনসম্পদ তৈরি করতে মেধাবী ছাত্রছাত্রীই প্রয়োজন। পাসের হার বৃদ্ধি করে আপাত শিক্ষার প্রসার হলেও মান না বাড়লে স্থায়ী ক্ষতি হয়। তাই আমরা চাই, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মেধার বিকাশ ঘটুক। শেষ পর্যন্ত যদি কোনো ছাত্রছাত্রী পাস না করতে পারে তার জন্য প্রচলিত সংস্কৃতি অনুসারে তার ফেল করার কারণ উদ্ঘাটন করতে ব্যস্ত না হয়ে তাকে বোঝানো যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত তো সে অবশ্যই জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। জীবনযুদ্ধের পরীক্ষার মতো কঠিন পরীক্ষা আর কী আছে। পাস করাটাকে আমরা যত সহজে প্রচার করি, ফেল করাটাকে গ্রহণ করার মন মানসিকতা আজও গড়ে ওঠেনি। যার কারণে একেবারেই অর্থহীনভাবে কয়েকটি জীবন প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরই ঝরে যায়। এই অহেতুক জীবনের থেমে যাওয়াগুলো মেনে নেওয়া যায় না।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আত্মহত্যা,শিশু,পরীক্ষার ফল,ফেল
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close