রেজাউল করিম খোকন

  ০৭ জানুয়ারি, ২০২০

দেশ এখন সামনে এগিয়ে

স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশকে নানা চড়াই-উতরাই পথ পাড়ি দিয়ে আজকের পর্যায়ে পৌঁছাতে হয়েছে। বাংলাদেশের দীর্ঘ অভিযাত্রায় অনেক সংকট, বাধাবিপত্তি এসেছে, সংকট-সমস্যা অতিক্রম করে সম্ভাবনার দিকে আবার এগিয়ে গেছে দেশ। এ সময় বাংলাদেশ কতটা এগিয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে কতটা সক্ষম, স্বাবলম্বী, সচ্ছল এবং শক্তিশালী হয়েছে; তা বিচার-বিশ্লেষণ করতে গেলে অনেক বিষয়ই সামনে এসে দাঁড়ায়। দিন দিন সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো। এটা আরোপিতভাবে নয়, স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থনীতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি ছিল একসময়ে এ অঞ্চলে। কিন্তু সেই কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে ক্রমেই বেরিয়ে এসে শিল্প ও সেবা খাতমুখী হয়েছে আমাদের অর্থনীতি।

স্বাধীনতার পর বিগত ৪৮ বছরে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলো পাল্টেছে। ক্রমেই শিল্প ও সেবা খাতের বিকাশ হয়েছে। এর ফলে অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো অনেকটাই বদলে গেছে। সময়ের আবর্তনে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকারও বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক গুণ। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেক পালাবদল ঘটেছে। নানা চড়াই-উতরাই ধাপ অতিক্রম করে বর্তমানে আমাদের অর্থনীতি একটি ভালো পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। একসময়ে অভাব, দারিদ্র্য ও দুর্বল অর্থনৈতিক কাঠামোর কারণে বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। এখন আর সেই দুর্বল অবস্থানে নেই বাংলাদেশ। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ আরো আগেই। অনুন্নত দেশ হিসেবে একসময় পরিচিত ছিল যে বাংলাদেশ, এখন তা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গণ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৭০ সালে এ দেশের অর্থনীতিতে মোট জাতীয় উৎপাদনের আকার ছিল মাত্র ৪৫০ কোটি ডলার। তৎকালীন সময়ে মুদ্রা বিনিময় হার ছিল প্রতি ডলারে ৭ টাকা ২৮ পয়সা। সেই হিসাবে অর্থনীতির আকার দাঁড়ায় ৩ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ফুলেফেঁপে যে পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, সেটাও আমাদের বিরাট একটি সাফল্য বলা চলে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশের নানাদিক বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয়ই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং তা হলো আমাদের অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে এক ধরনের শিল্পবিপ্লব ঘটেছে। এখানকার অর্থনীতিতে শিল্প খাতের অবদান কয়েকগুণ বেড়েছে। শিল্পবিপ্লবের ৮০ বছরে ইংল্যান্ড জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ২০ শতাংশ থেকে ৩৩ শতাংশে উন্নীত করেছিল। আমাদের অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অবদান কমলেও উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। বাংলাদেশের জনসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি থেকে ১৬-১৭ কোটিতে পৌঁছলেও খাদ্য ঘাটতি হয়নি। এটিও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় একটি সাফল্য হিসেবে ধরা যায়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চূড়ান্ত হিসাবে বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। টাকার অঙ্কে জিডিপির আকার ২৫ লাখ ৪২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। বর্তমানে মাথাপিছু জাতীয় আয় ১৯০৯ ডলার। ডলারের দিক দিয়ে মাথাপিছু আয় গত বছর সাময়িক যে প্রাক্কলন করা হয়েছিল ১৯০৯ ডলার, চূড়ান্ত হিসাবে তাই হয়েছে। টাকার অঙ্কে যা ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের গার্মেন্ট পণ্য রফতানিকারক শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে একটি। গার্মেন্টশিল্প থেকেই আমাদের রফতানি আয়ের সিংহভাগ আসছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কর্মী, বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিক্ষকরা তাদের পেশায় নিয়োজিত আছেন। দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন তারা। রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়ছে দিন দিন।

গত নভেম্বরে প্রবাসীরা ১৫৬ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় পাঠিয়েছেন। তার আগের মাসে অক্টোবরে পাঠিয়েছিলেন ১৬৪ কোটি ডলার। গত ২০১৮ সালের নভেম্বরের তুলনায় ২০১৯- সালের নভেম্বরে প্রবাসী আয় বেড়েছে। গত বছরের নভেম্বরে দেশে প্রবাসী আয় এসেছিল ১১৮ কোটি ডলার। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে প্রবাসী আয় বেড়েছে ৩২ শতাংশ। বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে অনেক গুণ। উন্নত ও আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের কারণে শাকসবজি, ফলমূল উৎপাদন যেমন বেড়েছে; তেমনিভাবে মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশুর খামার প্রতিষ্ঠার ফলে মাছ, মাংস, ডিম, দুধের চাহিদা পূরণ হচ্ছে সহজেই। একসময়ের খাদ্য ঘাটতির দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ খাদ্যে স্বাবলম্বী হয়েছে, এটা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য একটি সাফল্য।

আর্থিক খাতে নানা পরিবর্তন ও রূপান্তর প্রক্রিয়া এখন সময়ের দাবি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে বাংলাদেশে। মাইক্রো ফাইন্যান্স থেকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তীকরণের রূপান্তর আমাদের অর্থনীতিতে একটি আলোচিত বিষয় সন্দেহ নেই। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর আর্থিক সেবার বিকাশ এখন দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে অনেক গতিশীল করেছে। মোবাইল ফোন এবং ডিজিটাল আর্থিক লেনদেন দেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনেছে। আমাদের দেশের ৮০ শতাংশ জনগোষ্ঠী এখন মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) অর্থাৎ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই যথেষ্ট সাফল্যের প্রমাণ দিয়েছে। চলমান এসডিজি (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল) অর্থাৎ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনেও বাংলাদেশ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার পর বিজয়ের ৪৮ বছরে আমাদের দীর্ঘ পথচলা শেষে এখন আমরা কোথায় পৌঁছেছি, তার হিসাব-নিকাশ, মূল্যায়ন করতে হবে। অমিত সম্ভাবনার একটি দেশ হিসেবে এখন বাংলাদেশকে চেনে সারা বিশ্ব। দেশের অনেক প্রবৃদ্ধি হলেও কিন্তু কিছু মানুষ এখনো পেছনে পড়ে আছে নানা ক্ষেত্রে। এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। আমাদের সবার জন্য উন্নয়নের এবং সমৃদ্ধির সুফল ভোগ করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল বৈষম্যহীন একটি সমাজ এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। তার সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে আমরা সবাইকে নিয়েই এগোতে চাই। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী ট্যানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, পায়রা বন্দর প্রভৃতি মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষে আগামী এক দশকে বাংলাদেশ অগ্রগতি-সমৃদ্ধির আরো উজ্জ্বল অবস্থানে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে—আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
এগিয়ে,দেশ,অর্থনীতি
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close