তাওহীদুল ইসলাম

  ২৬ নভেম্বর, ২০১৮

সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় নির্বাচন

আমাদের বয়স অল্প, তাই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লিখতে ভয় হয়। সাংবাদিকতা বিষয়ে লেখাপড়া করি, তাই ভয়ের মাঝেও লিখতে মন চায়। বাংলাদেশে একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া আরম্ভ হওয়ার পর থেকে তার প্রতি গভীরভাবে মনোনিবেশ করে আছি। আওয়ামী লীগ কারো সঙ্গে আলোচনায় না বসার পক্ষে ছিল। তখন বিরোধী শক্তিগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কী করবে না, অনুরূপ একটা দুদল্যমনতা বিরাজ করছিল। ড. কামাল হোসেন যখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে সংলাপের প্রস্তাব দিয়ে চিঠি দিলেন, তখন প্রধানমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গণভবনে সংলাপে বসতে সম্মত হয়ে ড. কামালের কাছে নিমন্ত্রণপত্র পাঠালেন। তবে তিনি নিমন্ত্রণপত্রে উল্লেখ করলেন আলোচনা শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে হবে।

ড. কামাল তার চিঠির সঙ্গে তাদের সাত দফা প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন, সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী আলোচনার ভিত্তি হবে শাসনতন্ত্র, এ কথাটাই বলেছিলেন। গণভবনে আলোচনায় উভয় পক্ষ বসল, দীর্ঘ সময়ব্যাপী আলোচনা হলো। সংলাপে বিরোধীপক্ষ তেমন কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করতে পালল না। কারণ তারাও তো দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল, তাদের অতীত ইতিহাসও তো ভালো নয়। যাক। সংলাপে বিরোধীপক্ষের মান ভেঙেছে, এখন তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছে। এখন আশা করা যায়, ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদের নির্বাচনে মহাসমারোহে সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হবে।

এখন দেশে নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে এবং মনে হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত দুই মার্কার নির্বাচন হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের মার্কা হবে নৌকা আর ড. কামালের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যার মূল রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি এবং মার্কা হবে ধানের শীষ। আসলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মূল নেত্রী হচ্ছেন খালেদা জিয়া। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চেরিটেবল ট্রাস্টের মামলায় সর্বমোট তার ১৭ বছর জেল হয়েছে এবং তিনি এখন ঢাকা কেন্দ্রীয় (পুরনো) কারাগারে আছেন। বিএনপির দ্বিতীয় নেতা তারেক জিয়াও ফেরারি আসামি হিসেবে লন্ডনে অবস্থান করছেন। তারও মানি লন্ডারিং ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ১৭ বছর জেল হয়েছে আর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। নেতৃত্বশূন্যতার কারণে ঐক্যফ্রন্ট প্রক্রিয়ায় ড. কামাল, আ স ম আবদুর রব আর কাদের সিদ্দিকীকে বিএনপির সঙ্গে টেনে আনা হয়েছে। এসব কিছুর কারিগর ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বেগম জিয়া একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন কী পারবেন না, তা নিয়ে সংশয় আছে। এ নিয়ে অনেক বিজ্ঞব্যক্তি পত্রিকায় লিখেছেন। দণ্ডিত ব্যক্তির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা নিয়ে হাইকোর্টের কোনো সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তসহ কোনো রায় নেই, যা আছে তা সাংঘর্ষিক। তবে বিশেষজ্ঞদের লেখা পড়ে বোঝা গেল, সাজা হাইকোর্ট কর্তৃক স্থগিত না হওয়া পর্যন্ত দণ্ডিত কোনো ব্যক্তি নির্বাচন করতে পারবেন না। শাসনতন্ত্রে এ বিষয়ে যা লেখা আছে, তা সুস্পষ্ট। অবশ্য এরই মধ্যে সাজা স্থগিত করার জন্য বেগম জিয়ার পক্ষ থেকে রিট করা হয়েছে।

এবারের নির্বাচনে বহুধাবিভক্ত ইসলামিক দলগুলোও বিদ্বাবিভক্ত হয়ে দুই জোটে যোগদান করছে। তবে চরমোনাইয়ের পীর সাহেবের ইসলামিক আন্দোলন পৃথকভাবে নির্বাচন করছে। অবশ্য দেশব্যাপী তাদের সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে। তারা তাদের ৩০০ প্রার্থীর নামও ঘোষণা করেছে। প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে চমক দেখালেও ইসলামিক আন্দোলনের প্রার্থী জিতে আসবেন খুবই কম, কারণ তারা এখনো কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটব্যাংক সৃষ্টি করতে পারেনি। গতবার তারা প্রত্যেকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাদের মেয়র প্রার্থী দিয়েছিলেন এবং দেখা গেছে ভোটপ্রাপ্তিতে তাদের প্রার্থী আওয়ামী লীগ, বিএনপির পরই তৃতীয় স্থানে ছিলেন। জামায়াতে ইসলামীও নাকি স্বতন্ত্রভাবে স্বতন্ত্র মার্কা নিয়ে নির্বাচন করবে। অবশ্য তাদের বিধ্বস্ত অবস্থা। নির্বাচনে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাদের পক্ষে সুবিধা করে ওঠা খুবই কঠিন। তারা যদি বিএনপির মার্কা নিয়ে মিলেমিশে নির্বাচন করে, তবে কয়েকটা সিট হয়তো পেতে পারে।

একাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপ্রার্থীর সংখ্যা অকল্পনীয়ভাবে বেশি। ৩০০ আসনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সংখ্যা ৪ হাজার ২৩ জন আর বিএনপি প্রার্থীর সংখ্যা ৪ হাজার ৫৮০ জন। অন্যান্য দল জোট মিলে মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা ১২ হাজারের কাছাকাছি। গড়ে প্রতি আসনে ৪০ জন। প্রধানমন্ত্রী তার দলের এ সংখ্যা নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন এবং তিনি এটাকে নেতৃত্ব গড়ে না ওঠার লক্ষণ বলে উল্লেখ করেছেন। প্রতিটি কেন্দ্রে উভয় জোট মনোনয়ন স্থির করতে হিমশিম খাচ্ছে। হয়তো বা শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। এবারের একাদশ সংসদ নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। শুনেছি আওয়ামী লীগ কিছু কিছু রদবদল ছাড়া তাদের আগের সংসদ সদস্যদের আবার মনোনয়ন দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের এ সংসদ সদস্যরা দশ বছরব্যাপী সংসদে আছেন। নিজ নিজ এলাকায় তাদের অবস্থান গভীরে প্রোথিত হয়ে গেছে। তাদের মূল উৎপাটন কঠিন হবে। তাদের সঙ্গে জনসাধারণের ব্যাপক সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। তাদের হাত দিয়ে প্রতিটি এলাকায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কাজও হয়েছে। কিন্তু তারা প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধিতার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা আছে, যাকে ইংরেজিতে অ্যানটি ইনকামবেনসি ফ্যাক্টর বলে। তবে গত সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের মতো আওয়ামী লীগ তাদের নেতাকর্মী ও সক্রিয় সমর্থক দিয়ে যদি কেন্দ্রে কেন্দ্রে সয়লাব অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে, তবে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা কেটে যাবে। সুতরাং আওয়ামী লীগ যদি তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসতে চায়, তবে তাদের কর্মীদের জানবাছ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। আত্মকলহ বিস্মৃত হতে হবে।

আওয়ামী লীগ কর্মীদের বোঝা উচিত, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও দণ্ডিত আসামিদের ফাঁসি, যুদ্ধ-অপরাধীদের বিচার ও দণ্ডিতদের ফাঁসি, জেলহত্যা মামলার বিচার ও দণ্ডিতদের ফাঁসি ইত্যাদি কারণে বিরাট একটা গোষ্ঠী আওয়ামী লীগের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য বিক্ষুব্ধ হয় আছে। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে না পারলে হয়তো তারা সে ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারে। সুতরাং আওয়ামী লীগ কর্মীদের এবারের নির্বাচনে হয়তো বা অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত মনে করে কাজ করতে হবে। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে আওয়ামী লীগ কর্মীরা কাজ করতে হবে। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে আওয়ামী লীগ কর্মীরা কাজ করলে বিজয় তাদের হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা কম।

বিএনপিরও জনপ্রিয়তা আছে কিন্তু মাঠের অবস্থা তাদের অনুকূলে নয়। অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করতে না পারলে তাদের পক্ষে বিজয়ী হওয়া খুবই কঠিন হবে। সর্বোপরি তারা তাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থী বিষয়ে কোনো ঘোষণা না দিয়ে নির্বাচনে যাচ্ছে। বেগম জিয়া জেলে এবং খুবই অসুস্থ। সুতরাং তার পক্ষে প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব নয়। ড. কামাল নিজে বলেছেন তিনি নির্বাচনেও লড়বেন না, আবার ক্ষমতায়ও যাবেন না। দেখা যাচ্ছে তারেক জিয়া লন্ডন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। সম্ভবত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের তিনিই প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থী। তিনি অনভিজ্ঞ ও কমশিক্ষিত লোক এবং ২০০১ সালে তার মা বেগম খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন ‘হাওয়া ভবন’ থেকে প্যারালাল সরকার পরিচালনা করে বহুভাবে বিতর্কিত হয়েছেন। সম্ভবত সে কারণে নির্বাচনের আগে বিএনপি তাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থীর কথা বলছেন না। হাবভাবে মনে হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত তারেক জিয়াই তাদের প্রধানমন্ত্রী হবেন। ড. কামাল চলন শক্তি রহিত লোক। ধরাধরি করে সভা-সমিতিতে নিতে হয়। অনুরূপ লোক জ্ঞানী হলেও তাদের দিয়ে রাষ্ট্র চালানো দুষ্কর। সুতরাং মনে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী পদের বিতর্ক নিয়েই বিএনপি নির্বাচনে যাবে।

লেখক : বিশ্লেষক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জাতীয় নির্বাচন,কলাম,ভাবনা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close