মো. কায়ছার আলী

  ০১ জানুয়ারি, ২০১৮

উৎসব

বইয়ের ঘ্রাণে ম-ম

আজ ১ জানুয়ারি, ২০১৮ সোমবার। বিশ্বের মতো এ দেশেও পালিত হচ্ছে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মাঝে হ্যাপি নিউইয়ার-২০১৮। আবার অন্যদিকে বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে ‘পাঠ্যপুস্তক উৎসব দিবস’। এ বছর প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, এসএসসি ভোকেশনাল, ইবতেদায়ি, দাখিল ও দাখিল ভোকেশনালে প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীর জন্য ৩৫ কোটি ৪২ লাখ ৯০ হাজার ১৬২টি পাঠ্যবই সকল জেলা, উপজেলা, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছানো হয়েছে।

এবার দ্বিতীয়বারের মতো প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে ব্রেইল বই দিচ্ছে সরকার। এছাড়া ৫টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিশুদের নিজেদের মাতৃভাষায় বই দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকপর্যায়ে (মাদ্রাসা ও সমমানসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে) জাতীয়ভাবে পালিত হচ্ছে ‘পাঠ্যপুস্তক উৎসব দিবস’। এই উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানীসহ শহর-বন্দর, গ্রাম, নিভৃত পল্লী, দুর্গম পাহাড়ি এলাকা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, চর, হাওর, বাঁওড়সহ প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় নতুন বই পেয়ে নিজ নিজ ঘরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ফিরছে ভিশন-২০২১।

সূর্য যেভাবে ধনী, গরিব, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে সমানভাবে আলো ও তাপ বিলিয়ে দেয়, ঠিক সেভাবেই বর্তমান সরকার বছরের প্রথম দিবসেই নতুন পাঠ্যবই বিতরণ করে সবাইকে উজ্জীবিত করেছে। একই নেটওয়ার্ক বা একটি বিনি সুতোর মালা দিয়ে সুন্দরভাবে গেঁথে সাজিয়ে দিয়েছে। আমার জানা মতে, গ্রামের বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী মার্চ বা এপ্রিলের আগে তাদের পাঠ্যবই কিনতে পারত না। তারা আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও বড় ভাই-বোনদের কাছ থেকে ছেঁড়া বা পুরাতন বই অর্ধ মূল্য বা স্বল্প মূল্য দিয়ে কিনে লেখাপড়া করত।

সত্যি কথা বললে বলতে হয়, ছাত্রছাত্রীদের নতুন বই না হলে হৃদয়ে বা মনে উৎসাহ তৈরি হয় না। পাঠ্যবইয়ের অভাবে তাই ইচ্ছা থাকলেও শিক্ষকরা শ্রেণিতে বছরের শুরুতে পরিপূর্ণ পাঠদান করতে পারতেন না। কিছু সংখ্যক অভিভাবক উপবৃত্তির টাকা দিয়ে সংসারের খরচ চালাতেন এবং বই কিনে দিতে পারতেন না। পূর্বেও উপবৃত্তি চালু ছিল শুধু ছাত্রদের মধ্যে। এখনো চালু আছে। চালু আছে দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মাঝে, যাতে তারা লেখাপড়ায় উৎসাহ পায়। ৮ম বছরের মতো নতুন পাঠ্যবই পাওয়ায় বছরের প্রথম দিনটিতে শুরু হলো পরিপূর্ণ কর্ম দিবস। আজ বিদ্যালয়গুলো যেন কানায় কানায় পূর্ণতা লাভ করেছে। গত সাত বছর যাবত (২ জানুয়ারি) ছোট্ট সোনামণিরা গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠো পথে দৌড়ে তাদের প্রাণপ্রিয় বিদ্যালয়ের দিকে ছুটে যায় নতুন বই হাতে পাওয়ার প্রত্যাশায়। অবাক করা বিষয় হলো এত বিপুল সংখ্যাক বই পৃথিবীতে কোথাও বিতরণ করা হয় না এবং শিক্ষায় ছেলেমেয়ে সমতা অর্জনে এ দেশ বিশ্বের রোল মডেল। ৫৫০ জন শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ দিয়ে একটি নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন করে ১১১টি বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে এবং প্রথমবারের মতো পাঠ্যবইগুলো ওয়েবসাইটে পাওয়া যাচ্ছে। আইসিটি, কম্পিউটার শিক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন, মেয়েদের শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা, চারু ও কারুকলা, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন বিষয় সুন্দরভাবে পাঠ্যবইতে সংযোজন করা হয়েছে। যা এর আগে কেউ চিন্তাও করেনি।

জে এস সি বা বার্ষিক পরীক্ষা শেষে শীতকালীন বা বড়দিন উপলক্ষে প্রিয় বিদ্যালয় কয়েক দিন বন্ধ থাকায় অতি চেনাজানা পাশে বসা সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা হয়নি, ভাগভাগি করে খাওয়া হয়নি, মনের ভাব প্রকাশ হয়নি, খেলায় হারজিৎ হয়নি (বন্ধ বিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের ভালো লাগে না)। আসলে ছাত্রছাত্রীরা বিদ্যালয়কে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসে। প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী এরিকবার্ন বলেছেন, মানুষের জন্ম হয় তিনবার। প্রথমত, cellular Birth (মাতৃগর্ভে); দ্বিতীয়ত, Physical Birth (শারীরিকভাবে) এবং তৃতীয়ত, Social Birth (সামাজিকভাবে)। সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ হলো Social Birth যা শিশুর বয়স ৫+ হলে শুধু বিদ্যালয়ের মাধ্যমে অর্জিত হয়।

উন্নত বিশ্বে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বছরে ১২০০ ঘণ্টা এবং আমাদের দেশে মাত্র ৭০০ ঘণ্টা অবস্থান করে। এজন্য বর্তমান সরকার শিক্ষার্থীদের মেধা পরিপূর্ণ বিকাশের বা মুখস্থ নির্ভরতা সম্পূর্ণ কমিয়ে আনার জন্য S,A এবং C,A পদ্ধতি চালু করেছে। যাতে বিদ্যালয়ের working Hours বৃদ্ধি পায়। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ অনুযায়ী এদেশে ইতোমধ্যে চালু হয়েছে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম। এর ফলে বিদ্যালয়ের প্রতি শিশুদের আগ্রহ সৃষ্টি, সুকুমার বৃত্তির অনুশীলন, অন্যদের প্রতি সহনশীলতা এবং পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য শৃঙ্খলাবোধ সম্পর্কে ধারণা জন্মাচ্ছে। ৩১টি মাদ্রাসাতে অনার্স কোর্স এবং স্বতন্ত্র ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় চালুর পাশাপাশি সরকার কারিগরি, ভোকেশনালসহ সর্বত্র মানসম্মত শিক্ষার জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া পাঠ্যপুস্তকে মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ ২৩,৩৩১ স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন, শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের আওতায় স্নাতক পর্যায়ে বৃত্তি, শ্রেণিতে মানসম্পন্ন পাঠদানের C,D প্রদান, সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা, মাদ্রাসার মূলধারার সঙ্গে বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা অন্তর্ভুক্তি বা আধুনিকায়ন, ১০ লাখ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মূল্যায়নের বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ২৬,১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ২০১৩ সালে জাতীয়করণ করা হয়।

সেকায়েপ প্রকল্পের মাধ্যমে তুলনা মূলক পশ্চাৎপদ স্কুল বাছাই করে ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানের ১১ লাখ অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া হয়েছে। আইসিটি এডুকেশন চালুর পাশাপাশি মেয়েদের জন্য সাতটি বিভাগে সাতটি সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট করা হয়েছে। যা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে সবচেয়ে ভালো লেগেছে ৬০ দিনে পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ এবং ৫ম শ্রেণিতে (৯ বার) ৮ম শ্রেণিতে (৮ বার) মাদ্রাসাসহ পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ। এই পরীক্ষায় বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণের ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পরীক্ষাভীতি দূর হচ্ছে এবং প্রতিযোগিতা সম্পর্কে ধারণা জন্মাচ্ছে। অন্যদিকে মেধাবীরা বৃত্তি পাচ্ছে। পূর্বে প্রতিটি বিদ্যালয় থেকে কিছু সংখ্যক মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করত। কিন্তু বছরের শুরুতেই সরকার পাঠ্যবই প্রদান করায় এবং পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ায় শহরের মতো গ্রামেও জিপিএ-৫ বা (অদম্য মেধাবী) বৃত্তি পাচ্ছে।

শুধু এখানেই শেষ নয়, ইলেকট্রনিক বা প্রিন্ট মিডিয়ার কারণে অজোপাড়াগাঁ থেকে প্রতিভাবান খুদে কৃতী শিক্ষার্থীদের জীবনবৃত্তান্ত সারা দেশসহ সমগ্র বিশ্ব একসঙ্গে জানতে পারছে। ইতিহাসে পড়েছি নবাব শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় আট মণ চাল বা সস্তায় জিনিসপত্র পাওয়া যেত, কিন্তু বিনামূল্যে এ দেশে মাধ্যমিকে (সমমানসহ) পাঠ্যবই পাওয়া যেত কি না জানি না। তাই তো এ মহান কর্মসূচির জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নতুন বছর,নতুন বই,পাঠ্যপুস্তক উৎসব
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist