তমাল ফেরদৌস

  ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

গণমানুষের কবি দিলওয়ার

সাধারণ মানুষকে নিয়েই ব্যাপৃত ছিল তার চিন্তার জগৎ। অতি উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না বলেই হয়তো তিনি আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে হয়েছিলেন সবার। সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা, অনুবাদক, মুক্তিসংগ্রাম, দেশপ্রেম, আধ্যাত্মিকতা, কাব্যিকতা, প্রগতিশীলতা ও মানবিকতায় ছিলেন অনন্য। তিনি বাংলা একাডেমি ও একুশে পদকপ্রাপ্ত গণমানুষের কবি দিলওয়ার।

আমাদের মাঝে কবি দিলওয়ার আজ সশরীরে নেই, তবে কবির অজস্র সৃষ্টিকর্ম প্রতিনিয়ত তার উপস্থিতির জানান দেয়। পুরো নাম দিলওয়ার খান। জাতি-ধর্ম-বর্ণ তথা যেকোনো বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি ত্যাগ করেছিলেন পূর্ব পুরুষের ‘খান’ পদবি। তার পিতা মোহাম্মদ হাসান খান ও মাতা মোছাম্মাৎ রহিমুন্নেসা। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সপ্তম। আধ্যাত্মিক নগরী সিলেটের সুরমা নদীর তীরবর্তী ভার্থখলার খান মঞ্জিলে ১৯৩৭ সালের ১ জানুয়ারি তার জন্ম এবং একই স্থানে ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর মৃত্যু বরণ করেন। তার দুই স্ত্রী হলেন আনিসা দিলওয়ার ও ওয়ারিশা দিলওয়ার। ১৯৬০ সালে তিনি আনিসা খাতুনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর পত্নী বিয়োগ হলে ১৯৭৫ সালে ওয়ারিশাকে বিয়ে করেন।

গণমানুষের একান্ত কাছাকাছি চলে আসার পেছনে তার জাগ্রত বিবেকবোধ কাজ করেছিল। তাইতো কবির লেখা কবিতায় সমাজ ও মানুষের কথা বারবার উঠে এসেছে। তিনি তার লেখায় উদারতা, সহজ-সাবলীল শব্দচয়ন, গণমানুষের কল্যাণ, দেশাত্মবোধ, স্থানীয় সংস্কৃতির অভিব্যক্তি, অন্যায়-অবিচার, আগাগোড়া বাস্তবতার নিরিখে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। আমরা তার লেখনী হতে অনেক উপাদান পাই।

তার জীবনী ও লেখালেখির বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯৪৯ সালে ১২ বছর বয়সে প্রাচীনতম দৈনিক ‘যুগভেরী’তে তার ‘সাইফুল্লাহ হে নজরুল’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। অনেক লেখকই মনে করেন, তার লেখনী এবং চর্চায় কবি নজরুলের জীবন ও লেখার একটা প্রভাব রয়েছে। ১৯৫৩ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জিজ্ঞাসা’ প্রকাশিত হয়। তার ঘনিষ্ঠজন লেখক ও শিক্ষাবিদ আবদুল খালিক, কথা সাহিত্যিক আকমল হোসেন নিপু, কবি আহমদ সিরাজ প্রমুখের লেখনী এবং বিভিন্ন সময়ে আলাপচারিতা থেকে তার সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানা যায়। লেখক ও শিক্ষাবিদ আবদুল খালিকের পথের পাঁচালী উপন্যাসে শিক্ষা প্রসঙ্গ ও বিবিধ চিন্তা বই থেকে জানা যায়, কবি দিলওয়ারের লেখনী সফল, সার্থক ও সৃজনশীল। পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে কবি দিলওয়ারের কবিতায় বায়ান্ন-পরবর্তী আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতিতে সামন্তবাদবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল মানবতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনাপ্রসূত ধারার কাব্য সৃষ্টির প্রবণতা লক্ষণীয়।

আমার সঙ্গে কবির পরিচয় ও কথা হয় ২০০০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার সাপ্তাহিক ধলাই পত্রিকা অফিসে। তখন থেকে যতটুকু দেখেছি ও জেনেছি কবি দিলওয়ার একজন সাধারণ ঘরানার মানুষ ছিলেন। তার চেতনা ও লালিত স্বপ্নগুলোও ছিল সাধারণ মানের। তিনি প্রকৃতিকে লালন করতেন মনেপ্রাণে। তার কাব্যচর্চায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুই ক্ষেত্রেই প্রকৃতির প্রভাব রয়েছে। এছাড়া নিরলস অধ্যয়ন, অধ্যবসায়, জগৎ ও জীবন এবং

সর্বোপরি জীবন সম্পর্কে গভীর পাঠগ্রহণ তার কাব্যচর্চাকে এগিয়ে নিয়েছে। তিনি অর্ধ-শতাধিক বছর কাব্যচর্চা করেছেন। কবিতা, ছড়া, গান, গল্প ও প্রবন্ধ মিলে ২০-২২টি গ্রন্থ তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ফেসিং দ্য মিউজিক নামে তার একটি ইংরেজি কাব্যগ্রন্থও রয়েছে।

তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সংকলনগুলো হলো- সমস্বর (১৯৬৯-৭৪), উল্লাস (ফেব্রুয়ারি ১৯৭২), মৌমাছি (জুন ১৯৭৫), গ্রাম সুরমার ছড়া (১৯৭৬), মরূদ্যান (জানুয়ারি ১৯৮১), সময়ের ডাক (১৯৮৫), সিলেট পরিদর্শক (প্রধান সম্পাদক ১৯৮৬)। এছাড়া ১৯৬৪ সালে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ঐকতান, ১৯৬৫ সালে গীতিগ্রন্থ পূবাল হাওয়া, ১৯৬৯ সালে চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ উদ্ভিন্ন উল্লাস প্রকাশিত হয়।

কবি দিলওয়ার ১৯৬৭ সালে দৈনিক সংবাদের সহকারী সম্পাদক, ১৯৭৩-৭৪ সালে রুশ সংস্কৃতি কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘উদয়ন’ পত্রিকার সিনিয়র অনুবাদক, ১৯৭৪ সালে দৈনিক গণকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক ও ‘চলমান শব্দাবলী’ নামে কলাম লেখা এবং ১৯৫৬ সালে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা হাইস্কুলে দুই মাস শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন।

কবি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি, তবে ১৯৫২ সালে রাজা গিরিশচন্দ্র হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও ১৯৫৪ সালে সিলেটের মুরারীচাঁদ কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ১৯৫৭ সালে শারীরিক অসুস্থতার কারণে বিএ পরীক্ষা দিতে পারেননি।

তিনি ভারতের আসাম ও ত্রিপুরায় রাষ্ট্রীয়ভাবে সংবর্ধিত হয়েছেন। এছাড়া ২০০৮ সালে একুশে পদক, ১৯৮০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮৬ সালে ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ কর্তৃক আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে হবিগঞ্জের দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা স্মৃতিপদক ও সম্মাননা অর্জন এবং ১৯৮৭ সালের ৯ আগস্ট যুক্তরাজ্য প্রবাসী কর্তৃক লন্ডনের সিলেট সেন্টারে সংবর্ধিত হয়েছেন।

কবি দিলওয়ার ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৭০ সালে ‘সমস্বর লেখক ও শিল্পী সংস্থা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আত্মগোপনে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে গ্রামে গ্রামে গিয়ে কর্মী সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ প্রদানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। গণমানুষের কবি দিলওয়ার আমাদের মাঝে না থাকলেও তার রচনা যুগ যুগ ধরে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
দিলওয়ার,কবি দিলওয়ার,গণমানুষের কবি,কবিতা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist