মাহমুদুল হাসান, রাঙ্গাবালী (পটুয়াখালী)

  ১৪ অক্টোবর, ২০২২

লাইব্রেরি আছে, পাঠক নেই 

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

লাইব্রেরি (গ্রন্থাগার) আছে, কিন্তু প্রাণহীন। নেই শিক্ষার্থীদের কোলাহল। কোথাও অফিস কক্ষে আলমারিতে বন্দি বই, হয়তো খোলাই হয় না বহুদিন। কোথাও বইয়ের কিছু সংগ্রহ আছে, তবে তাকে লাইব্রেরি বলা চলে না। কোথাও কোথাও লাইব্রেরিয়ান থাকলেও অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে বইগুলো, যেন অনেকটাই অভিভাকহীন। এমন চিত্র পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। গত সোমবার (১০ অক্টোবর) সরেজমিনে গিয়ে এসব চিত্র দেখা গেছে। তবে কয়েকটিতে ব্যতিক্রম চিত্রও দেখা গেছে।

ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা ১১টা ৫৮ মিনিট। রাঙ্গাবালীর ছোটবাইশদিয়া ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসায় পাঠদান চলছে। এর ফাঁকে কথা হয় দুজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। জানতে চাওয়া হয় লাইব্রেরির কথা। লাইব্রেরি কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, সেটি মূলত লাইব্রেরি নয়, মাদ্রাসার সুপারের কক্ষ। সে কক্ষের এককোণে একটি আলমারিতে কিছু বই রাখা। আছে সুপারের চেয়ার-টেবিল। তার বিশ্রামের জন্য একটি চৌকিও। শিক্ষার্থীরা বলছে, সেটিই নাকি তাদের লাইব্রেরি। শিক্ষার্থীদের লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার সম্পর্কে তেমন ধারণাই নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদরাসা সুপার আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমাদের মাদরাসায় রুমস্বল্পতার কারণে লাইব্রেরি কক্ষই ব্যবহার করছি। আমাদের লাইব্রেরিয়ান নেই। সহকারী শিক্ষক দিয়ে এটি পরিচালনা করি। সরকারিভাবে আলমারি দেওয়া আছে। ওখানে বিশ্ব সাহিত্য, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নারের বই আছে। ফাঁকে ফাঁকে শিক্ষার্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্থীরা বই পড়ে। কিন্তু করোনার আগে বেশি জমজমাট ছিল।’

এরপর দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে ছোটবাইশদিয়া ফজলুল করিম মাধ্যমিক বিদ্যালয় যান এ প্রতিবেদক। সেখানে গিয়েও দেখা যায় প্রায় একই চিত্র। লাইব্রেরির জন্য আলাদা কক্ষ নেই। শিক্ষকদের বসার অফিস কক্ষের এককোণে পড়ে আছে বইভর্তি আলমারি। আছে লাইব্রেরিয়ান, কিন্তু নেই পরিচর্যা।

শিক্ষার্থীরা জানায়, তাদের স্কুলে লাইব্রেরি নেই। যদি লাইব্রেরি থাকত তাহলে অবসর সময়ে ঘোরাঘুরি না করে বই পাঠের সুযোগ থাকত। তবে প্রধান শিক্ষক বশির উদ্দিন শরত বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, ‘বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও আমাদের ছেলেমেয়েরা এই পাঠাগার থেকে বই নিয়ে পড়েছে। আমাদের স্কুল তহবিলের টাকা থেকেও বেশ কিছু বই কিনেছি।’

এর আগে প্রতিবেদক সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে রাঙ্গাবালী ছালেহা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ঘুরে আসেন। সেখানে গিয়ে দেখেন ছোট্ট একটি কক্ষে লাইব্রেরি। কক্ষটি তালাবদ্ধ। লাইব্রেরিয়ান এসে তালা খুললে দেখা যায়- আলমারিতে বই আছে। কিন্তু অবহেলা-অযত্নে বইগুলো পড়ে আছে। লাইব্রেরির ভেতরেই একটি চৌকি আছে। দেখে বোঝা যায় কেউ হয়তো সেখানে রাত্রিযাপন করেন। জানতে চাইলে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফিরোজ মিয়া ও লাইব্রেরিয়ান মো. চমক বলেন, ‘ভবন হওয়ার আগে যখন আমরা কাঠের রুমে ছিলাম, তখন কিছু বই উই পোকায় কেটেছে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কার্যক্রম তো আগে চলত। এখন কার্যক্রম চলে না।’

শুধু এই তিনটি প্রতিষ্ঠান নয়, উপজেলার বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে বই থাকলেও লাইব্রেরির জন্য আলাদা কক্ষ নেই। শিক্ষার্থীরা অনেকেই মনে করেন, অফিস কক্ষই তাদের লাইব্রেরি। আর প্রতিষ্ঠান প্রধানরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানের কক্ষ সংকটের কারণে লাইব্রেরির জন্য আলাদা কক্ষ দেওয়া যাচ্ছে না।

তবে এক-দুটি প্রতিষ্ঠানে এর ব্যতিক্রমও আছে। তেমনি একটি রাঙ্গাবালী মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ওই স্কুলে লাইব্রেরির জন্য আলাদা কক্ষ আছে। শিক্ষার্থীরা সেখানে গিয়ে বই পড়ে এবং বাড়িতেও নিয়ে যায় বলেও জানায় স্কুল কর্তৃপক্ষ। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানা যায়, এ উপজেলায় ১২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১১টি মাদরাসা এবং ৪টি কলেজ রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেকায়েপ প্রকল্পের পক্ষে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালনায় পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বাধীনতা, দেশ, কৃষ্টি ও সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে পাঠাভ্যাসে উৎসাহ এবং মানসিক বিকাশের জন্য স্কুল-মাদরাসার বই সরবারহ করা হতো। এ কার্যক্রম দেশের ২৫০টি উপজেলার মতো রাঙ্গাবালীতেও ২০১০ সালে শুরু হয়েছিল। কিন্তু এটির কার্যক্রম ২০১৮ সালে শেষ হয়। তাই বর্তমানে বই সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। তবে চলতি বছর আবারও এ কার্যক্রমটি শুরু হওয়ার কথা হবে বলে জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

এ ব্যাপারে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয়ের অ্যাকাডেমিক সুপারভাইজার অনাদি কুমার বাহাদুর বলেন, ‘লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার থাকার কথা। কিন্তু আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে জায়গা নেই। যার কারণে বইগুলো আলমারিতে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। আমাদের কাছে লাইব্রেরি বা বইয়ের জন্য কোনো বরাদ্দ আসে না। আগে স্কুল-মাদরাসায় লাইব্রেরিয়ান (গ্রন্থাগারিক) ছিলেন। এখন তাদেরও সর্বশেষ নীতিমালায় সহকারী শিক্ষক (গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান) করে দেওয়া হয়েছে। শুধু কলেজে লাইব্রেরিয়ান পদ আছে এখনও।’

তিনি আরো বলেন, ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠে উৎসাহ এবং জ্ঞান বিস্তারের জন্য পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বই দেওয়া হতো। প্রতিষ্ঠানে জায়গা না থাকায় শিক্ষার্থীরা বই ইস্যু করে বাসায় নিয়ে যেত। পড়ে আবার ফেরত দিত। কিন্তু এখন সেই কর্মসূচি বন্ধ।’

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রাঙ্গাবালী,লাইব্রেরী
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close