আলমগীর খোরশেদ
ইতিহাস-ঐতিহ্য
প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যের কথা
আদিম যুগের মানুষ চোখে যা দেখতেন, কানে যা শোনতেন, সকালে সূর্য ওঠা, সন্ধ্যায় সূর্য অস্ত, রাতে আকাশে উঁকি দেওয়া চাঁদ, ঝড়, বৃষ্টি, সহসা ভূমিকম্প এসবের ব্যাখ্যা খুঁজতেন। তারা অনুভব করতেন- এসবের পেছনে অজানা কোনো শক্তির অস্তিত্বকে। সব অনুভূতি ও ভাবনাকে লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন পুরাণ, ফোকলোর বা লোকগাথা, পরী কাহিনি, ধর্মীয় মূল্যবোধ, দেব-দেবীর জন্ম সব নিয়ে লিখে গেছেন। যা হয়ে গেছে মূল্যবান সাহিত্যের অংশ। তারা আদিম যুগের জীবনবোধ নিয়ে সমাজের কথাগুলো পরবর্তী লেখকদের অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। এভাবেই সাহিত্য চলে এসেছে যুগ থেকে যুগ, শতাব্দী থেকে শতাব্দী, কাল থেকে মহাকাল ধরে।
প্রাচীন গ্রিক সাহিত্য হলো সুপ্রাচীন কাল থেকে শুরু করে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সময় পর্যন্ত গ্রিক ভাষায় রচিত সাহিত্য। যা খৃস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দ থেকে চলমান। গ্রিক সাহিত্যের আদিমতম রচনাগুলোর মধ্যে কবি হোমারের মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’ দ্বারা মাইসিনীয় যুগ সম্পর্কে জানা যায়। গ্রিক মিথে সৃষ্টিতত্ত্ব, দেবতাদের জন্ম ও মানবজাতির সৃষ্টি নিয়ে প্রাচীন গ্রিসের চারণ কবি হেসিয়েড তার অমর দুটি গ্রন্থ ‘থিওগোনী’ ও ‘কার্যাবলি ও দিবসগুলো’ লিপিবদ্ধ করে গেছেন। যার সময় ছিল ৭৫০ খৃস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। গ্রিক সাহিত্যের প্রধান ভিত্তি হোমার ও হেসিয়েডের উল্লিখিত অমর গ্রন্থগুলো। তাদের এই ধারা বহমান ছিল ধ্রুপদি, হেলেনীয় ও রোমানযুগ পর্যন্ত। গ্রিক কাব্যধারাকে আরো এগিয়ে নিয়েছিলেন গীতিকবি স্যাফো, আলর্সেয়াস ও পিন্ডার। ইস্কিলুস ছিলেন প্রাচীনতম গ্রিক সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য ট্র্যাজিক নাট্যকার। আরেকজন লেখক সোফোক্লেস ইডিপাসের মতো ট্র্যাজিক রচনা করে ছিলেন। তার ‘রাজা ইডিপাস’ ও ‘অ্যান্তিগোনী’ নাটক দুটি তেমনি উল্লেখযোগ্য রচনা। নাট্যকার ইউরিপিদেসও ট্র্যাজিক নাটক লিখে সাহিত্যে সফলতা পান। কমেডি ধাঁচের লেখার পুরোনো শ্রেষ্ঠ নাট্যকার ছিলেন অ্যারিস্টোফেনিস।
ইতিহাসবিদ হ্যালিকার্নাসাস খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে তখন সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে লিখে ছিলেন ‘হিরোডোটাস’ ও ‘থুসিডাইডিস’ নামের দুটো অমর রচনাবলি। যা আজও গ্রিক সাহিত্যে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে পরিচিত। খৃস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর গ্রিক লেখক সামোসাটার লুসিয়ান প্রধানত স্যাটায়ার রচনা করেছিলেন। এই গ্রিক সাহিত্যাবলি অনুসরণ করে অনেক প্রাচীন রোমান লেখকরা তাদের লেখার অনুপ্রেরণা গ্রহণ করেছিলেন। প্রাচীন গ্রিকের শ্রেষ্ঠ গীতিকার ও কবি ছিলেন অ্যানাক্রেয়ন, যিনি আয়নিক উপভাষায় লিখেছেন। গ্রিক প্রাচীন পণ্ডিতদের কাছ থেকে ‘মাইমেসিস তত্ত্ব’ আর রোমানযুগ থেকে ‘সাবলাইম তত্ত্ব’ পেয়ে সাহিত্যের কার্যধারা আর সাহিত্যের শৈলী সম্পর্কে পরবর্তী লেখক সাহিত্যিকদের জ্ঞান আহরণে সুবিধা হয়েছে। খৃস্টীয় প্রথম শতকে ইংরেজিতে লেখা ‘অন সাবলাইম’ যার গ্রিক নাম ‘পেরিহিপসুস’-এর লেখক ছিলেন পিসোডো লন্জাইনাস। লেখক লন্জাইনাসের মতে, ‘লেখালেখির গুণটা সম্পূর্ণ ঈশ্বর প্রদত্ত, মহৎ লেখকের লেখা অনুসরণ করে লেখকদের সফলতা অর্জন হতে পারে, কল্পনা, ভাব, উপমার জোরে লেখক পৌঁছবে তার স্বপ্নচূড়ায়।’ প্রাচীন গ্রিকে কাটা মোমের ট্যাবলেট, চামড়া নির্মিত লেখার পৃষ্ঠা, যা বেশির ভাগই লেখা হতো প্যাপিরাসে, মাটির পাত্রে, সীসা খণ্ড, কাঠ কিংবা কাপড়ে লেখা হতো। ডিপিলন নামক শিলালিপি থেকে আদি প্রাচীন গ্রিকের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যসংশ্লিষ্ট তথ্যাদি পাওয়া গেছে। গ্রিক মিথের রোমান লেখক কবি ভার্জিল উনিশ খৃস্টপূর্ব থেকে সত্তর খৃস্টপূর্ব পর্যন্ত সাহিত্যচর্চা করেন। তিনি তার ‘ঈনিয়াড’ মহাকাব্যে ট্রয় নগরীর পতন, রাজপুত্র ঈনিয়াসের কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। ট্রোজান যুদ্ধের কাহিনি গ্রিক সাহিত্যে অনেক রচনায় চিত্রিত হয়েছে। যা সাহিত্যের দিকপাল হয়ে সব সাহিত্যিকের আজও অনুকরণীয় হয়ে আছে।
"