রুখসানা কাজল

  ০৩ মার্চ, ২০২৩

ধারাবাহিক উপন্যাস- ১৩

বায়োস্কোপ

চেহারা ছবিতে ভারিক্কি হয়ে যাওয়া ওমর বলেছিল, বলুন দেখি ইনু ভাই আমরা কি বিপ্লব করতে গেছিলাম! যাদের জন্য করছিলাম তারা আমাদের বিন্দুমাত্র বুঝত না। সমর্থন আর সহানুভূতি পেতে গেলে আগে তো বিপ্লব কি সেটা বুঝাতে হবে জনগণকে! মনিরের মৃত্যু আমি আজও মেনে নিতে পারি না। সেদিন ভিড়ের ভেতর আমিও ছিলাম টুপি পরে জায়নামাজ হাতে। নামাজের ভাব দেখাচ্ছিলাম যেন আমি মাদরাসার তালেবে এলেম। আমি সেদিন সত্যি নামাজ পড়েছিলাম আর পালাবার বুদ্ধি করেছিলাম। তবে পত্রিকা অফিসে চর ছিল। সেও ইনুদের ধরিয়ে দেয়নি। কি করে দেয় বলুন তো? সেও তো বিপ্লবের স্বপ্নভাঙা পাবলিক ছিল। আপনার জিগরি দোস্ত রওশন।

ইনু চমকে উঠেনি। পূরবী বা দলের অন্যরা শুনেও চমক খায়নি। ওরা বরাবর একটি সন্দেহের চোখ রেখেছিল রওশনের ওপর। কারণ ওর বাবা ছিল পুলিশের সাব-কনেস্টেবল। রওশন ওদের অনেক খবরও জানাত। বিশেষ করে ধরা পড়েও যেসব কমরেডরা বেঁচে ছিল তাদের খবর। এখন সুইজারল্যান্ডের ঠান্ডা দেশে সুইস বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে রওশন বেশ ভালো আছে। কোনো এক স্টক এক্সচেঞ্জ অফিসের সিকিউরিটি গার্ড। ওর বউ হাউস ওয়াইফ। শুনে ইনু ভেবেছিল, বাঙালি মানসিকতার জেরে রওশনই বোধহয় চাকরি করতে দেয়নি বউকে। পরে জেনেছে, ওর বউয়ের ইচ্ছা হয়নি। দোস্ত এসব দেশে নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য আছে। অবশ্য লাভ হয়েছে। বাঙালি বাঙালি ফ্লেভার পেয়েছি। ছেলেটি পাইলট আর মেয়ে স্টোরকিপারের জব করে। নো প্যানিক। ভালো আছি।

ভালো অবশ্য ইনুও আছে। তার বড় মেয়ে রুমকি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের কোনো এক ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক। সেই সঙ্গে তুখোড় হিউমেন অ্যাক্টিভিস্টও। দেশের যেকোনো অনুষ্ঠানে রুমকির বক্তব্য কান পেতে শোনে সবাই। এক শ্রেণির মানুষের কাছে রুমকি অসম্ভব জনপ্রিয়। ছোটোখাটো রাজনৈতিক নেতাদের চাইতেও বেশি সমাদৃত। এছাড়া নানা রকম ইস্যুভিত্তিক কর্মকাণ্ড নিয়ে পরিচালিত কয়েকটি এনজিওর স্লিপিং উপদেষ্টা সে। বছরের বেশ কয়েকটি দিন নানা রকমের সেমিনারে যোগ দিতে বিভিন্ন দেশের আমন্ত্রণ থাকে। রুমকি খুব যত্ন নিয়ে এই কাজগুলো করে। বিশেষত নারী শিশু এবং জেন্ডারবিষয়ক অনুষ্ঠানগুলোতে রুমকি ইনামদ্দীন বেশ সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। আজকাল বিশ্বিব্যাপী দুর্যোগ মোকাবিলা ও ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে প্রচুর কাজ করছে। যেসব খতিয়ান তুলে ধরে তাতে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থার নিশ্চয়তা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তা হয় ইনুর। হাতের মুঠোর মতো ছোট্ট দেশটির কি শেষ পর্যন্ত সলিল সমাধি হবে? এসব কাজ ছাড়াও গোপন স্তরে বিশেষ পরিচয়ও রয়েছে তার বড় মেয়ের। ধারণা করা হয়, রুমকি কিছু ছোট ছোট বামমনস্ক রাজনৈতিক দলের মদদ গুরু। যদিও বিশিষ্ট রাজনীতি বিশেষজ্ঞ হিসেবে তার স্বীকৃত এবং প্রকাশ্য পরিচয়ও রয়েছে। ইনু জানে এগুলো পকেট পূর্তির রাজনীতি মাত্র। সব বাংলাদেশে হাতে গোনা কয়েক হাজার বা লাখ নেতাকর্মী রয়েছে এসব দলের। এককভাবে দেশের প্রতিটি আসনে ক্যান্ডিডেট দেওয়ার মুরোদ নেই। কিন্তু এরা আন্দোলন করে খুব সাংঘাতিক পর্যায়ের। এদের কাজ হচ্ছে, সরকারবিরোধী কোনো ইস্যু নিয়ে সুদৃশ্য পোস্টার ফেস্টুন নিয়ে রাজধানীর স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে হত্যে দিয়ে বসে থাকা। নিয়মিত মিছিল করে পরিবেশ উত্তপ্ত রাখা। কখনো সরকারবিরোধী, কখনো ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান বা বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের বিপক্ষে সোচ্চার স্লোগানে প্রতিবাদ করে এরা উত্তাল করে দেয় রাজধানী। মাঝে মাঝে পুলিশি ধাওয়া মারধর, গ্রেপ্তারও চলে। ফেসবুক ভরে যায় এদের সমর্থনে। পোস্টের পর পোস্ট আসে। এভাবে কিছুদিন চলার পর এদের আর দেখা যায় না। তবে কিছু কিছু ইনোসেন্ট কর্মী বাদে এসব দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীর পরিচয়ের তলানিতে গেলে দেখা যায়, এদের বাবা বা দাদা-চাচারা ছিল সরাসরি বা প্রচ্ছন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পক্ষের লোক।

ইনু মাঝে মধ্যে রুমকিকে ঠাট্টা করে। রুমকি গায়ে না মেখে বাবাকে একটি নতুন সিগ্রেটের প্যাকেট উপহার দিয়ে একই ব্র্যান্ডের একটি নিজে ধরিয়ে বলে, তোমাদের দলে কতজন ছিল বাপ? যাওবা ছিল সব বনে জঙ্গলে, গর্ত খানায়। জনগণের মারও খেয়েছ তোমরা। আমাদের জনপ্রিয়তা দেখেছে?

ইনুর বুড়ো মুখে আলো ছড়িয়ে পড়ে কিন্তু আমাদের আদর্শ ছিল। কমিউনিজমকে আমরা কমোডিটি করে তুলিনি।

জনগণ চাইলে কার্ল মার্ক্সও নবী হয়ে যেত। আর কমিউনিজম এখন কমোডিটি বাপ। চীনকে দেখো। রাশিয়া তো আলু হয়ে গেছে। পুতিন খালু যতটা না পলিটিশিয়ান তারচে বেশি ভিলেন। চে গুয়েভারাকে শিল্পপতিরা গেঞ্জি আর কফি কাপে গ্লোরিয়াস করে রেখেছে আর তোমার চীন তো বাপ...

তার্কিক কিছু বলতে গিয়েও গিলে ফেলে ইনু। সত্যিটা তো আর শাক দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না। তার মেয়ে এমনিতে এক্সট্রা অর্ডিনারি স্কলার নয়। নিজেকে অনেক বছর ধরে খেটে তৈরি করেছে রুমকি। কাঁচা পাকা চুলের ইন্টেলিজেন্ট, উইটি এই প্রিটি মেয়েটি পয়েন্ট ধরে ধরে ওর জন্মদাতাকে বুঝিয়ে দেবে, ইজম আর আইডোলোজি কি পরিমাণে, কোথায় কোন দেশে, কত দামে বিক্রি হয়েছে, হচ্ছে তার প্রমাণ নথি!

ছাত্র অবস্থায় আটশট্টি উনসত্তর সালের দিকে ইনুও জড়িয়ে গেছিল গুপ্ত রাজনীতির সঙ্গে। তখন ওদের বুকে সত্যিকারের আদর্শ ও স্লোগান ছিল। এদেশে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠায় টেকনিক্যাল ভুল থাকলেও ওদের দলীয় নেতা ও কর্মীদের ভেতর তখন পর্যন্ত আদর্শের ক্ষেত্রে কোনো রকমের বিভ্রান্তি বা আপস ছিল না। তবে সত্যটি হচ্ছে এই, দীর্ঘ উপনিবেশ আমলের ধারণাপুষ্ট এদেশের জনগণ হঠাৎ করে কম্যুনিজমকে গ্রহণ করতে কোনোভাবেই তৈরি ছিল না। তাছাড়া কম্যুনিস্টরা ধর্ম মানে না, তারা পাঁড় নাস্তিক- পুঁজিবাদীদের কল্যাণে যুগ যুগ ধরে বিশ্বজুড়ে এরকম একটি নেগেটিভ প্রচারণা গড়ে উঠেছে। ইনু ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছে, সোভিয়েত রাশিয়ায় কেউ ধর্মকর্ম মানে না। লেনিন স্ট্যালিন সব মসজিদ আর গির্জাগুলো জাদুঘর বানিয়ে ফেলেছে। ঈদের নামাজ পড়তে দেয় না। কেউ পড়তে চাইলে তাকে নাকি গলায় শেকল বেঁধে ঝুলিয়ে দেয় পাইন গাছের ডালে। রাশিয়ায় আল্লাহ রাসুল যিশু মোজেস কেউ নেই। সবাই পালিয়েছে নাস্তিকদের দেশ ছেড়ে- এই প্রচারণার ফাঁদে পা রেখে এদেশের ধর্মভীরু ক্ষুধার্ত অসহায় মানুষগুলো বিশ্বাস করে যে, কম্যুনিস্ট মানেই নাস্তিক। সাত আসমানের উপর থেকে মাটির পৃথিবীকে শাসন করার আল্লাহ রাসুল ভগবানের সঙ্গে কমিউনজমের এত দ্বন্দ্ব কেন কে জানে! প্রতিটি ধর্মেই তো ভালো ভালো কথা আছে। দরিদ্রকে দান কর, শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগে তার প্রাপ্য দিয়ে দাও, পরিবারের বাবা-মা এবংবয়োজ্যৈষ্ঠয়দের সম্মান সালাম তাদের ভালো মন্দের দিকে নজর রাখো, দেশকে ভালোবাস, প্রতারণা করো না, অন্যায়ভাবে অঢেল ধনসম্পত্তি বানিও না ইত্যাদি কথাগুলোর সঙ্গে কমিউনজমের তো দ্বৈরথ হওয়ার কথা নয়! কমিউনিজমের সঙ্গে যা কিছু পার্থক্য তা হচ্ছে নারীদের ক্ষেত্রে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close