রনি রেজা

  ০১ জুলাই, ২০২২

বিদ্রোহী কবিতার সমাজতত্ত্ব

একটি কবিতা কীভাবে সমাজ সংস্করণের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। বলা হয়ে থাকে, তার কবিত্বশক্তির সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটেছে এখানেই। কবিতাটি লেখার সময় নজরুল ইসলাম ২২ বছরের তাগড়া জোয়ান। তার মাত্র দুই বছর আগে ফিরেছেন সেনাবাহিনী থেকে। বিপুল উদ্যমে লিখছেন- ‘শাত-ইল-আরব’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘কোরবানী’, ‘মোহররম’, ‘আগমনী’, ‘রণভেরী’, ‘আনোয়ার’, ‘কামাল পাশা’র মতো সব কবিতা। এমন সময়ে ‘বিদ্রোহী’ রচনা করে চমকে দেন তরুণ কবি। কবিতাটির রচনাকাল এবং কবির বয়সকাল বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়- সমাজ পরিবর্তনের কী এক ঝাঁজালো স্বপ্ন নিয়ে তিনি এটি রচনা করেছিলেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি নজরুল রচনা করেন ১৯২১ সালে। তখন উপনিবেশবাদ চলছে। পৃথিবীর ৭২ শতাংশ রাষ্ট্রই উপনিবেশ ছিল। আর প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ ছিল পরাধীন। ভারতে চলছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। মূলত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন তখন জোরদার হয়ে ওঠে। কোথাও এতটুকু শান্তি নেই বলা চলে। উপনিবেশ আর পরাধীনতার কশাঘাতে মানুষ জর্জরিত, পর্যুদস্ত মানবতা। এমন সময়ে এক বিদ্রোহী তরুণের থেকে এমন সৃষ্টি চমকিত করলেও অনাকাঙ্ক্ষিত বলা যায় না।

‘বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিবেশে জনমানসে সে সময় ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রবল। ১৯২০-এর সেপ্টেম্বরে কলকাতায় ভারতীয় কংগ্রেসের যে অধিবেশনে অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হয়, তাতে সাংবাদিক হিসেবে এ দুজনই ছিলেন উপস্থিত। অতঃপর অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের যৌথতায় স্বরাজের দাবিতে যখন প্রকম্পিত হয়ে ওঠে সারা ভারত, তখন কবিও তার সঙ্গে একান্তভাবে একাত্ম, মিছিলে সক্রিয়। ‘বিদ্রোহী’ রচনার মাসটিতেই গ্রেপ্তার হন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ; তার পত্রিকার জন্য পরের মাসেই এক বৈঠকে লিখে ফেলেন সাড়াজাগানো সংগীত ‘ভাঙার গান’ (কারার ওই লৌহ কপাট)। অন্যদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালেই সাম্রাজ্যগ্রাসী ইউরোপের ধনলোভী উন্মাদনার বিপরীতে সংঘটিত হয় রুশ বিপ্লবের মতো শোষণমুক্তির দুনিয়া কাঁপানো ঘটনা। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার সমসময়ে মস্কো থেকে পাঠানো এম এন রায়ের দূতের সঙ্গে মুজফ্ফর আহ্মদ ও তার একান্ত সাক্ষাৎ ঘটে। ‘বিদ্রোহী’ রচনার মাসটিতেই মুজফ্ফর আহ্মদ ও তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা নজরুলকে সঙ্গে নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কথা ভাবেন। নজরুল অবশ্য পার্টিতে সক্রিয় হননি; তবে বৈপ্লবিক সমাজ রূপান্তরের চেতনায় ছিলেন দারুণভাবে আন্দোলিত ও উজ্জীবিত।’ নজরুলের বিদ্রোহী ব্যক্তিত্ববাদ রূপের প্রকাশ ঘটেছিল তারও অনেক আগে।

‘শিয়ারসোল রাজ স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় কাজী নজরুল ইসলামের এক শিক্ষক নিবারণ চন্দ্র ঘটক তাকে ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত করান। তখন থেকে নজরুলের রাজনৈতিক চেতনায় সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশদের তাড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন প্রোথিত হয়। মুজফ্ফর আহ্মদসহ কতিপয় বামপন্থি রাজনৈতিক কর্মী ও নেতার সংস্পর্শে এসে নজরুল তার বিপ্লবী চেতনাকে আরও শানিত করতে সক্ষম হন। নবযুগ পত্রিকায় ‘ম্যায় ভুঁখা হুঁ’ জাতীয় প্রবন্ধগুলো, এর কিছু পরে তিনি ও মুজফ্ফর আহ্মদের সম্পাদনায় প্রকাশিত ধূমকেতু পত্রিকায় তার ‘স্বরাজ টরাজ বুঝি না’ ধরনের সম্পাদকীয়গুলো এবং এরপর বামপন্থি পত্রিকা লাঙ্গল-এর ‘সাম্যবাদী’ গুচ্ছের কবিতাগুলো প্রমাণ করে যে, নজরুলের ব্যক্তিত্ববাদ তার বিদ্রোহী সত্তার সমষ্টিগত পরিচয়- রাজনৈতিক পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদী ধর্মপরায়ণতা, নারীর অবদমন ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে। জ্ঞানত জীবনের পুরোটা সময় তিনি প্রায় চরম দারিদ্র্যের মধ্যে কাটিয়েছিলেন। দারিদ্র্যকে তিনি নিজের হাতের রেখার মতো চিনতেন। সেজন্য তার সব বিদ্রোহী চেতনার উৎসস্বরূপ দারিদ্র্যকে চিহ্নিত করা যায় : ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান।’

কাজী নজরুল ইসলাম যেভাবে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে ‘বিদ্রোহী’ রচনা করেছেন তেমনি বলা যায়, তার বিদ্রোহী হয়ে ওঠা এবং ‘বিদ্রোহী’ শিরোনামে লেখা কবিতাও সমাজেরই সৃষ্টি। কডওয়েলের বক্তব্য অনুসারে, ‘কবিতা হচ্ছে জমাটবদ্ধ সামাজিক ইতিহাস’। কারণ কবিরাও তো সামাজিক জীব। অন্য সবার সঙ্গে তারাও একই সমাজে বাস করেন। একই রাষ্ট্রের উৎপাদিত শস্যাদি খেয়ে জীবন বাঁচান। সাধারণের সঙ্গে একই স্কুল-কলেজে লেখাপড়া চালিয়ে যান এবং তার সব সৃষ্টিকর্মের রসদ এ সমাজ থেকেই পেয়ে থাকেন।

‘বিদ্রোহী’ কবিতার একটি অন্যতম লক্ষণীয় দিক ‘আমি’ শব্দের অধিক ব্যবহার। এখানে কবি নিজেকে সমগ্র নির্যাতিত, নিষ্পেষিত মানুষের মুখপাত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। বিদ্রোহে সূক্ষ্মভাবেই আমরা হয়ে ওঠে আমি। ওই এক আমির কণ্ঠে ভর করেই এগিয়ে যায় একটি জাতি, একটি প্রদেশ কিংবা একটি সমাজের সব কথা।

‘বল বীর’ শব্দ দিয়ে যে কবিতার শুরু তার পুরোটাতেই নজরুল সমাজকে এঁকেছেন অতি সূক্ষ্মভাবে। বলেছেন ঘুণে ধরা সমাজের বৈষম্যের কথা। বলেছেন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। উপনিবেশবাদের ওই সময়ে বীর সন্তানদের প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত দিয়েই কবি শুরু করেছিলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা।

সমাজচিন্তক নজরুল ইসলাম সর্বদা সমাজের কল্যাণের কথাই চিন্তা করেছেন। ছাড় দেননি গোড়া ধার্মিকদেরও। সমাজের জন্য যা কিছু ক্ষতির, অকল্যাণকর মনে করেছেন তার বিপক্ষেই শক্ত অবস্থান নিয়েছেন নজরুল ইসলাম। প্রতিষ্ঠা করেছেন শক্ত উচ্চারণ। তিনি বলেছেন- ‘আমাদের সমাজের কল্যাণকামী যেসব মৌলানা সাহেবান খাল কাটিয়া বেনো-জল আনিয়াছিলেন, তাহারা যদি ভবিষ্যৎদর্শী হইতেন, তাহা হইলে দেখিতে পাইতেন- বেনো-জলের সাথে সাথে ঘরের পুকুরের জলও সব বাহির হইয়া গিয়াছে। উপরন্তু সেই খাল বাহিয়া কুসংস্কারের অৎস্র কুমির আসিয়া ভিড় করিয়াছে। মৌলানা মৌলবী সাহেবকে সওয়া যায়, মোল্লাও চক্ষুকর্ণ বুঁজিয়া সহিতে পারি, কিন্তু কাঠমোল্লার অত্যাচার অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে। ইসলামের কল্যাণের নামে ইহারা যে কওমের জাতির ধর্মেও কি অনিষ্ট করিতেছেন তাহা বুঝিবার মতো জ্ঞান নাই বলিয়াই ইহাদের ক্ষমা করা যায়। ইহারা প্রায় প্রত্যেকেই ‘মনে মনে শাহ ফরীদ, বগল-মে ইট’ ইহাদের নীতি ‘মুর্দা দোজখণ্ডমে যায় য়্যা বেহেশত-মে যায়, মেরা হালুয়া রুটি-সে কাম।’

আলোচনার শুরুতেই উল্লেখ করেছি, ‘বিদ্রোহী কবিতায় কাজী নজরুল ইসলামের কবিত্বশক্তির সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটেছে। এখানে তিনি কাউকে ছাড় দেননি। সচেতনভাবেই তিনি প্রতিষ্ঠিত সমাজের বিপক্ষে উচ্চারণ করেছেন।

কবিতাটির একটি আলোচিত পঙ্ক্তি- ‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।’

এই পঙ্তির দ্বারাই সমাজকে চূড়ান্ত আঘাতটি করেছেন নজরুল। উপনিবেশবাদ থেকে শুরু করে শতবর্ষ পরের আজকের এই সমাজেও কুর্নিশ একটি সমাজের চিরন্তন প্রথা। অধস্তন কুর্নিশ করবে ঊর্ধ্বতনকে, সমাজপতিদের সমীহ করবে সাধারণ নাগরিক, শক্তিশালীকে ভয় করে, তোয়াজ করে চলবে দুর্বল; এটাই তো সমাজের চিরপ্রথা। তবে নজরুল কেন বললেন, ‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।’ সামাজিকভাবে বাস করতে হলে এটা কি আদৌ সম্ভব? এই উচ্চারণ নজরুল ইসলাম তার ‘কুলিমজুর’ কবিতায়ও প্রতিষ্ঠা করেছেন। খুবই স্পষ্টভাবে কবি নির্যাতিতের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। এটাই বিদ্রোহের মূল মন্ত্র। বিদ্রোহ সব সময় ক্ষমতার বিপক্ষে হয়। এবং বিদ্রোহ শুরু হয় বরাবরই নিচ থেকে। বিদ্রোহকে যদি পিরামিডের সঙ্গে তুলনা করা হয় তবে বলতে হবে এর চূড়া তীক্ষè থাকে এবং উঁচুতে অবস্থান করে। তবে দৃশ্যত এটি চিকন বা দুর্বল বলা যায়। আর নিচের দিকে অনেক প্রশস্ত এবং মজবুত থাকলেও চূড়ায় পৌঁছানো সহজ হয়ে ওঠে না। সেখানে ঐক্য দরকার হয়। এবং চূড়ায় আহরণের মতো সাহসী শক্তির দরকার হয়। তখনই হয় বিদ্রোহ। সেখানে সব নির্যাতিতের পাশে থাকে বিদ্রোহ।

‘বিদ্রোহী’ কবিতার আরেকটি পঙ্ক্তির দিকে একটু লক্ষ করা যাক। তিনি বলেছেন, ‘আমি- বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর।’

সমাজতত্ত্বও বিদ্রোহেরই ফসল। ‘একটি পা-িত্যপূর্ণ শৃঙ্খলা, যা প্রাথমিকভাবে ফরাসি বিপ্লবের পরপরই জ্ঞানদান চিন্তার ফলে সমাজের প্রত্যক্ষবাদী বিজ্ঞান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটি বিজ্ঞান এবং জ্ঞানের দর্শনের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের ফসল। বৃহত্তর অর্থে দর্শনের সাধারণ ভিত্তি থেকে পূর্বনির্ধারিত ক্ষেত্র হিসেবে সামাজিক বিশ্লেষণের জন্ম। আধুনিকতা, পুঁজিবাদ, নগরায়ণ, যৌক্তিকীকরণ, ধর্মনিরপেক্ষতা, উপনিবেশ স্থাপন এবং সাম্রাজ্যবাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আধুনিক অ্যাকাডেমিক সমাজতত্ত্ব আবির্ভূত হয়েছে। ১৯ শতকের শেষ দিকে সমাজবিজ্ঞান তার সামাজিকতার একক এবং নজরদারির নিমিত্তে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রসমূহে একটি বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি করে একে প্রতিষ্ঠান হিসেবে গঠন করে। আলোকায়নের চেয়ে আধুনিকতার ধারণার ওপর গুরুত্বারোপ করে, প্রায়ই শাস্ত্রীয় রাজনৈতিক দর্শন থেকে সমাজতাত্ত্বিক আলোচনাকে আলাদা করা হয়।

কাজী নজরুল ইসলাম শুধু সাম্যের বাণী প্রচার করেননি। তিনি সামাজিক অসাম্যের কদর্য রূপটি প্রত্যক্ষ করেছেন, এর ভয়াবহতা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন এবং তার সব কর্ম ও সাধনা দিয়ে সব ধরনের অসাম্য দূর করার চেষ্টা করেছেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শেষ দিকে কবি উল্লেখ করেছেন- ‘মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত,/যবে- উৎ?পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না- /অত্যাচারীর খক্ষ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না- /বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত।’

যুগে যুগে সমাজ পরিবর্তিত হয়েছে। সমাজের প্রয়োজনেই সমাজের পরিবর্তন ঘটেছে। এর পেছনে ভূমিকা পালন করেছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মতো অনেক মৌলিক চিন্তা।

সমাজতাত্ত্বিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে কাজী নজরুল ইসলামের কবি হয়ে ওঠা থেকে শুরু করে পুরো জীবনেই বিদ্রোহ পরিলক্ষিত হয়। লেটোগানের নজরুল, রুটির দোকানের নজরুল আর সেনাবাহিনীতে কাজ করা নজরুল; সবখানেই ছিল বিদ্রোহ। সমগ্র বাঙালির ইতিহাসে দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না, যিনি এমনভাবে পুরো জীবনভর মানুষের জয়গান ও মুক্তির কথা বলেছেন। বাংলার সাহিত্যে এমন অন্য কাউকে পাওয়া যাবে না যিনি সামাজিক শোষণ, নিপীড়ন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এ রকম নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close