অরূপ তালুকদার

  ২২ জানুয়ারি, ২০২১

নাসিমের চলে যাওয়া

যতিহীন কষ্টের দ্যোতনা

আসলে কেউ কথা রাখে না। নুরুল করিম নাসিমও রাখেননি, নাকি রাখতে পারেননি, জানার সুযোগও ছিল না।

তার সঙ্গে আমার সরাসরি আলাপ-পরিচয় বছর-পাঁচেক আগে, যখন আবার নতুন করে ঢাকায় থাকা শুরু করেছি, তখন থেকে। এর আগে লেখালেখির সুবাদে নামটা জানা ছিল।

ঢাকায় আসার পরে কখনো-সখনো দেখা হতো। যে কদিন ঢাকা ক্লাবে দেখা হয়েছে, সে সময় অনিবার্যভাবে সঙ্গে থাকতেন। চমৎকার একজন মানুষ। শিক্ষাবিদ-লেখক মোহিত উল আলমও যতদূর জানি, এখন তিনি চট্টগ্রামে থাকেন। অনেকটা আমার মতো নাসিমেরও ফেব্রুয়ারির বইমেলায় যাওয়ার জন্য খুব একটা উৎসাহ কখনো ছিল না। সব মিলিয়ে দু-তিনবার যাওয়া-আসা হতো।

গত বইমেলার একেবারে শেষ দিকে এক দিন এলিফ্যান্ট রোডে ওর বাসার সামনে থেকে দুজনে একটা রিকশায় করে সন্ধ্যার কিছু আগে চলে গিয়েছিলাম বইমেলায়। সেদিন যাওয়ার সময় এটা-সেটা নিয়ে কথা হচ্ছিল।

বলছিলাম, এখন কী লিখছেন?

বললেন, লিখতে গেলে আলস্য লাগে, তাই প্রায় সময় লিখতে ইচ্ছে করে না। তা ছাড়া প্রতি সপ্তাহে ঢাকার বাইরে কর্মস্থলে যাওয়ার তাড়া থাকে।

বললাম, বয়স বাড়ছে তো, তাই এমন মনে হচ্ছে, তবে লেখার নিয়মিত অভ্যাস থাকলে লিখতে পারবেন।

চলন্ত রিকশায় বসে সামনের দিকে তাকিয়ে থেকে অস্ফুট স্বরে বললেন, দেখি, চেষ্টা করব ও ভাবছি, বেশি দিন আর ঢাকার বাইরে থাকব না, চলে আসব...

সেদিনের পর থেকে বেশ কিছুদিন যোগাযোগ ছিল না। হঠাৎ এক দিন ফোন করে বইমেলায় তিনটি ছোট ছোট উপন্যাস নিয়ে বেরোনো একখানা বই পাঠালেন, কোনো পত্রিকায় বইটি সম্পর্কে একটা আলোচনা লেখার জন্য। দেখলাম, উপন্যাস তিনটির দুটি প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক জনকণ্ঠের ২০১৬ এবং ২০১৭-এর ঈদসংখ্যায়, অন্যটি নতুনমাত্রা নামের মাসিক পত্রিকায়।

কিন্তু নানা কারণে সেটা সে সময়ে আর লেখা হয়ে ওঠেনি। একসময় ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিলাম। এত দিন সে বিষয়টি নিয়ে আমার তেমন কোনো দুঃখবোধও হয়নি। কিন্তু এখন হচ্ছে। আসলে লেখাটার জন্য না হলেও নাসিমের জন্য তো কিছুটা সময় অবশ্যই দিতে পারতাম। তিনিও মনে মনে খুশি হতেন।

গত বছরের মার্চ মাসের মাঝামাঝি একবার বরিশালে গিয়েছিলাম। ফিরে এসেছিলাম সপ্তাহখানেক পরে। ফিরে আসার পরদিন পেলাম নাসিমের টেলিফোন, বরিশাল থেকে ফিরলেন কবে?

বললাম, গতকাল বিকালে।

কালি ও কলমের এ সংখ্যায় আপনার গল্প বেরিয়েছে, দেখেছেন?

না, এখনো দেখিনি। বললাম, পরে দেখা যাবে। আগে বলুন কেমন আছেন?

না, খুব শান্তিতে নেই। পাইলসের সমস্যা খুবই ভোগাচ্ছে। চিকিৎসা চলছে। চলাফেরায় খুব কষ্ট হচ্ছে।

বললাম, বাড়িতেই তো আছেন, কী লিখছেন?

কিছুই না, লেখাটেখা আর হচ্ছে না। মনটাও কেন যেন ভালো নেই।

বললাম, আপনার মুস্তাফিজ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয় না? তার সঙ্গে গল্পসল্প করুন, দেখবেন মন ভালো হয়ে গেছে।

আমার চেয়েও নাসিমের বেশি পরিচিত আর একজন মজার মানুষ ছিলেন সিটি ইউনিভার্সিটির ভিসি মুস্তাফিজুর রহমান।

বললেন, তিনি এখন দেশের বাইরে, না হলে তার সঙ্গে বসে গল্পটল্প করা যেত। কিন্তু এখন তা আর হচ্ছে না। আপনিও তো ঘর থেকে একেবারেই বের হচ্ছেন না।

এরপর আবার কিছুদিনের বিরতি। হঠাৎ এক দিন এক শুক্রবার সকালের দিকে নাসিমের ফোন পেলাম, কী করছেন?

বললাম, তেমন কিছু না, একটি জাতীয় দৈনিকের মঙ্গলবারের কলাম রেডি করছি। কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকা আর কি!

বললেন, আজ সমকালের কালের খেয়ায় আপনার লেখা দেখলাম। আপনি দেখেছেন?

বললাম, এখনো দেখিনি। কিন্তু ভাই, আপনি রোজ কটা পত্রিকা পড়েন বলেন তো!

ফোনের ওপাশ থেকে মৃদু হাসির শব্দ পেলাম। বললেন, এখন অনেকেই করোনা সংক্রমণের ভয়ে পত্রিকা পড়া ছেড়ে দিয়েছে, আমি ছাড়িনি। আপনি?

বললাম, আমি সেই প্রথম থেকেই পত্রিকা নেই না। কখনো কখনো মোবাইলে দেখি। যাই হোক, এসব থাক, আচ্ছা বলুন তো, ফোনের এই নম্বরটা কার?

কোনটার কথা বলছেন?

যে নম্বর থেকে কথা বলছেন।

এটা তো আমাদের ল্যান্ড ফোনের নম্বর। এটা অনেক সাশ্রয়ী। অনেকক্ষণ কথা বললেও খরচ নেই। এখন থেকে এই ফোন দিয়েই আপনার সঙ্গে কথা বলব। আচ্ছা, এক দিন আসতে পারেন না?

দেখি, আসব এক দিন। বললাম, আসলে কি জানেন, ভয় লাগে।

এসব কথা বলতে বলতে সময় চলে যায়। দিন চলে যায়। বলার জন্য শুধু কথা থেকে যায়।

এরপর নভেম্বর মাসে জরুরি কাজে আরেকবার বরিশালে যেতে হয়েছিল। তার দুদিন আগে নাসিমকে ফোন করলাম, বরিশাল যাচ্ছি, সপ্তাহখানেক পরে ফিরব। এর মধ্যে আপনি একটা গল্প পাঠাবেন একটি সাহিত্য ম্যাগাজিনের জন্য। তাড়াতাড়ি চাই। দিতে পারবেন না?

দেখি, পারব, দেরি হবে না। পাঠিয়ে দেব দেখবেন।

আপনার সঙ্গে কথা শেষ করে ইমেইলে ঠিকানা পাঠাচ্ছি। এখানে পাঠাবেন, ঠিক আছে?

ঠিক আছে। দু-তিন দিনের মধ্যেই পেয়ে যাবেন।

সে লেখা আর পেলাম কোথায়? পরের সপ্তাহে ঢাকায় ফিরলাম। মানুষটির দেখাই তো আর পেলাম না। পেলাম কি? পেলাম না তো! এই নশ্বর মানবজীবনে কখন যে কী ঘটে যায়, কেউ কি বলতে পারে?

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close