ড. সোমা দাশ পুরকায়স্থ

  ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

বীরেন মুখার্জীর কবিতায় সম্মোহন

‘অনুভব’ আর ‘কল্পনা’ শব্দ দুটি ‘কবি’ শব্দটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আমরা ধরেই নিই যে, অনুভব আর কল্পনার প্রখরতা একজন প্রকৃত কবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আবার কারো কারো বেলায় ‘অনুভব’ শব্দটিও গভীরতর দ্যোতনা নিয়ে হাজির হয়, যেমন জীবনানন্দ দাশ। তিনি অনুভব করেছিলেন, কবির ব্যক্তিত্ব এবং বাইরের প্রকৃতির নানা জিনিসের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অনিবার্য ফল হচ্ছে কবিতা। বিশ্বপ্রকৃতি, পৃথিবী ও মানুষের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে লিখিত হয়েছে তার বহু কবিতা। আধুনিক বাংলা কবিতায় নব্বইয়ের সময়পর্বে আবির্ভূত বীরেন মুখার্জীকেও অনুভবের কবি বলা যেতে পারে, তার কবিতায় উপস্থিত ত্রিবিধ অনুষঙ্গের সমাবেশ বিবেচনায়। প্রকৃতির উপস্থিতি, মানবমনের জিজ্ঞাসা, আন্তঃসম্পর্কসহ ঘটমান পারিপার্শ্বিকতা কবি হৃদয়ে যে অনুরণন তোলে তারই রূপায়ণ সুস্পষ্ট তার কবিতায়। কবিতাকে সংহত ও প্রগাঢ় করে তুলতে তিনি যেমন নতুন নতুন শব্দ এবং নতুনতর অনুষঙ্গ এনেছেন, তেমনি নানা বৈপরীত্যের সম্মিলনে পাঠককে সপ্রশ্ন করে তুলেছেন।

কবিতার কারিগরি দিক কিংবা প্রকৌশলগত পরিপ্রেক্ষিত যা-ই বলি না কেন, শব্দ গঠন, ভাষাশৈলী-বৈচিত্র্য, চিত্রকল্পের সমন্বয়ে অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রেও বীরেন মুখার্জীর অবস্থান স্বতন্ত্র। তার ‘উ™£ান্ত সময়’ (১৯৯৮), ‘প্রণয়ের চিহ্নপর্ব’ (২০০৯), ‘প্লানচেট ভোর কিংবা মাতাল বাতাস’ (২০১১), ‘নৈঃশব্দ্যের ঘ্রাণ’ (২০১২), ‘পালকের ঐশ্বর্য’ (২০১৩), ‘মৌনতা’ (দীর্ঘ কবিতা ২০১৩) এবং ‘জলের কারুকাজ’ (২০১৪), ‘হেমন্তের অর্কেস্ট্রা’ (২০১৬), ‘গুচ্ছঘাসের অন্ধকার’ (২০১৭), ‘জতুগৃহের ভস্ম’ (২০২০) এবং ‘মায়া ও অশ্রুনিনাদ’ (২০২০) গ্রন্থের কবিতায় উপরোক্ত বিবেচনাসমূহ সঘন।

‘একজন কবির তূণে কী কী অস্ত্র থাকবে? অনুভূতি, কল্পনা, ব্রেনসেল, মনের চোখ, আর ডুব দিতে পারার সাহস। এই সঙ্গে, পাঠ। সে পাঠ উপনিষদ থেকে কামসূত্র, প্লেটো থেকে নীটসে, মনোবিদ্যা থেকে আকাশবিদ্যা, মানে, সব’Ñ উক্তিটি করেছেন কবি-আলোচক সমরজিৎ সিনহা। আমরা বীরেনের কবিতায় এসবের সম্মিলন দেখতে পাই। তার ‘মুহূর্তের গান’ কবিতাটি লক্ষ করিÑ ‘অন্তরে লাগালে খিলÑ/কী যে মুশকিল,/দৌড়ে এসেও থামতে হয়;/বলি ধীর লয়েÑ/প্রেম অথবা প্রণয়ে/থামতে পারাও মন্দ নয়!’

স্বল্পায়তনের এ সিরিজ কবিতাটিতে তিনি মনোজাগতিক পরিভ্রমণের কথা বলতে চেয়েছেন। তিনি বুঝতে চেয়েছেন, মানুষের মন এক নিমিষেই ভ্রমণ করতে পারে মহাসৃষ্টির সকল মেরুতে; এটা তার কবিতাযাপনেরই অংশ, আর সেখান থেকে ফিরতে বা থামতে পারার কৌশলটাই মূলত কবিতা হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেছেন। চারণেই এই ব্যাপ্তির মধ্যেই সৃষ্টির সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়।

এবার একটু পেছন থেকে আসা যেতে পারে। ফরাসি বিপ্লব থেকে যে ইউরোপীয় আধুনিকতার জন্ম; সাহিত্যের প্রবাহিত ধারাবাহিকতায় সেটি প্রভাব বিস্তার করেছে ধীরগতিতেই। এর সঙ্গে কাজ করেছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ নানা পরিবর্তন। তবে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতা নামক ধারণার হাওয়া লেগেছে অনেক পরে; উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। আর কবিতায় এসেছে আরো পরে, বলতে গেলে বিংশ শতকের তৃতীয় দশকে। বাংলা কবিতায় এখনো সেই তিরিশের আবহই ঘুরেফিরে উচ্চকিত। কবিতার সঙ্গে অবশ্য নানা ‘ইজম’ বা ‘বাদ’ যুক্ত হয়েছে। অনেকে কবিতাকে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি ভাষায়ও কবিতা রচনা করছেন। কিন্তু বীরেনের কবিতা কবিতার উচ্চমার্গীয় পর্যায় বা প্রমিত ভাষার উচ্চারণে ঋদ্ধ। তিনি নিরীক্ষাপ্রবণ হলেও ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের ভেতর দিয়ে কবিতাচর্চা করলেও কবিতাকে ক্ষুদ্র গ-ির মধ্যে বৃত্তাবদ্ধ হতে দেননি।

এ কথা বলা বোধকরি অযৌক্তিক হয় না যে, বীরেন মুখার্জীর শব্দ নিয়ে খেলা এবং যাপনের নানাবিধ প্রপঞ্চের সমন্বয়ে যে শব্দের জাদু তিনি উপস্থাপন করেন, তা পাঠককে মোহগ্রস্ত করে। তার কবিতা বারবার পঠনে তীব্র থেকে তীব্রতর হয় বোধ, আর এটা হয় মূলত কবিতার সম্মোহনী শক্তির কারণে। ‘সম্মোহন’ কবিতার একটি বিশেষ গুণ হিসেবে চিহ্নিত করেন কাব্যবোদ্ধারা। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রকৃত কবিতার রয়েছে অন্তর্নিহিত এক শক্তি, যা একই সঙ্গে চিত্তাকর্ষক এবং অনুরণন জাগানিয়া। কবিতার এসব পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় বীরেন মুখার্জী যে স্বতন্ত্র স্বরের শক্তিমান কবি, তা সংশয়হীন চিত্তেই স্বীকার করা যায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close