বিবিসি

  ১৯ জানুয়ারি, ২০২৪

পাকিস্তান-ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক

পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী জাইশ আল-আদলকে লক্ষ্য করে ইরান সম্প্রতি হামলা চালানোর পর পাল্টা হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। এতে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাত সীমানা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। পাকিস্তানের দাবি, ইরানের হামলায় পাকিস্তানের দুই শিশু নিহত এবং তিনজন আহত হয়েছেন।

ইরান দাবি করেছে, জাইশ আল-আদল বা ‘ন্যায়বিচার ও সমতার পক্ষে যোদ্ধা’ নামে একটি সুন্নি জঙ্গিগোষ্ঠী পাকিস্তান-ইরান সীমান্তে সক্রিয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল তাদের মদদ দিয়ে যাচ্ছে। অতীতে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বেশ কয়েকটি হামলার দায় স্বীকার করেছে এই গোষ্ঠী। এরা ইরান সরকারের বিরোধিতা করে। এই গোষ্ঠী নিজেদের ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে ‘সুন্নি অধিকার রক্ষক’ হিসেবে দাবি করে।

২০০৯ সালে ইরান আবদুল মালেক রিগি নামে এই জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রধানকে গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বোমা হামলা চালানো এবং যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ট হিসেবে কাজ করার অভিযোগ আনা হয়। ২০১০ সালে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

সে সময় ইরানে নিয়োজিত থাকা পাকিস্তানের সাবেক কূটনীতিক মোহাম্মদ আব্বাসি বলেছিলেন, রিগির গ্রেপ্তারে পাকিস্তানের ভূমিকা ছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা বলছে, ২০০৫ সালে ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের ওপর হামলার অভিযোগ আনা হয় এই জঙ্গিগোষ্ঠীর ওপর।

ইরানের সামরিক বাহিনী বা রিভলিউশনারি গার্ড কোর ইরাক এবং সিরিয়ায় বিভিন্ন লক্ষ্যে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা চালানোর পরের দিনই ওই বিমান হামলা চালানো হয়।

পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ মুশাহিদ হুসাইন সাইদ বলেন, ‘এই হামলা দ্বিপক্ষীয় চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক প্রটোকলের লঙ্ঘন। এটি এমন একসময়ে ঘটল যখন ইসলামী ঐক্যের চেতনাকে ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টায় গাজায় গণহত্যা চালানো হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ইসরায়েলের প্রতি হতাশা প্রকাশ করার পরিবর্তে তেহরান গত ২৪ ঘণ্টায় তিনটি মুসলিম দেশের ওপর হামলা চালিয়েছে। এ ধরনের ভণ্ডামি এবং দ্বিচারিতার তীব্র নিন্দা করা উচিত।

ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যকার সম্পর্কে সুসময় ও দুঃসময়-দুটোই ছিল। ইরানই প্রথম দেশ হিসেবে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং বিদেশে পাকিস্তানের প্রথম দূতাবাসও ইরানে স্থাপন করা হয়েছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সময় দুদেশ পরস্পরকে সহায়তা করেছে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তেহরান ইসলামাবাদকে সমর্থন দিয়েছিল।

১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লব এবং পাকিস্তানে সৌদি-অনুপ্রাণিত ওয়াহাবি ধারার ইসলামচর্চা- দুদেশের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়তে থাকে।

১৯৯০-এর দশকে পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িকতা এবং শিয়া ছায়াযুদ্ধে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয় ইরানের বিরুদ্ধে। একই সময়ে কাবুলভিত্তিক তালেবান সরকারকে ইসলামাবাদের সমর্থনে অস্বস্তি ছিল তেহরানের।

ভারতের সঙ্গে ইরানের সহযোগিতা এবং ওয়াশিংটনের সঙ্গে পাকিস্তানের কৌশলগত মিত্রতা দুদেশকে পরস্পর থেকে আরো দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তবু দুদেশ বড় কোনো দ্বন্দ্বে জড়ায়নি।

ইসলামাবাদের ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষণা ফেলো আরহামা সিদ্দিকা বলেন, ২০২১ সাল থেকে দুদেশের সম্পর্ক বেশ ইতিবাচকভাবেই এগিয়ে চলছিল। পাকিস্তান তার ভূখণ্ডের অখণ্ডতার বিষয়ে কোনো ছাড় দিতে পারবে না। আবার আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্র উন্মুক্ত করতে চায় না।

ইকরাম সেহগাল নামে একজন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক বলেন, পাকিস্তান এ পর্যন্ত ইরানের সঙ্গে যথাযথভাবেই সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছে।

এমনও সময় ছিল যখন পাকিস্তান ‘সৌদি শিবির’-এর অংশ হতে চায়নি। বিশেষ করে ২০১৫ সালে যখন সৌদির নেতৃত্বে সুন্নি জোট ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে, তখন পাকিস্তান এর অংশ হতে অসম্মতি জানায়।

পাকিস্তান তখন বুঝতে পেরেছিল যে, আঞ্চলিক সাম্প্রদায়িক সংঘাতে জড়ালে তার বিপদ হচ্ছে, দেশের মধ্যে শিয়া ও সুন্নি জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন একটি লড়াই ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। তবে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সাম্প্রতিক সুসম্পর্ক এই চাপ কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে।

ইকরাম সেহগাল বিশ্বাস করেন, ইরান বোঝে যে, তারা আরেকটি প্রতিবেশীর সঙ্গে নতুন করে আরেকটি যুদ্ধাবস্থা শুরু করতে পারবে না, কারণ দেশটি এরই মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক সংঘাতে জড়িয়ে রয়েছে। এ ছাড়া মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখেও বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে দেশটিকে।

তিনি মনে করেন, পাকিস্তানের উচিত জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া এবং অন্য দেশে হামলা চালাতে নিজের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে না দেওয়া।

‘ইরানেরও এ ধরনের বিপর্যয়মূলক পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। তা না হলে, এ ধরনের পদক্ষেপ আরেকটি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে, যা এই অঞ্চলের মানুষ সহ্য করতে পারবে না।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close