আহমদ বশীর

  ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

পাথর আলী মানুষ

‘তুই একটা আস্তা ব্যাক্কল, ব্যাক্কলের পো ব্যাক্কল- অহন হালার পো ঠ্যালাডা সামলাও’ - জোছনার মধ্য দিয়ে এই স্বর ছুটতে থাকে। সারা রাস্তায় নিস্তব্ধতা গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যাচ্ছে, যেন কেউ নেই, এমনকি কমলাপুর স্টেশনের কাছে থেকে শান্টিংয়ের শব্দ থেমে গেছে, গাছের পাতার কম্পনের মধ্যে কোথাও কোথাও শুধু ঝিঁঝির বাঁশি এসে মানুষের ঘুমিয়ে থাকার কান্নাকে ঢেকে রাখে।

পাথর আলীর আঙুলের ডগায় তখনো কাঁচা পেঁয়াজের ঝাঁজালো গন্ধ, নাকের কাছে ধরলে সেই গন্ধ তার সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে মগজের ফাঁকা অংশে শৈশবকে টেনে আনে, আর সব পেছন দিকে সরে যায়- ল্যাম্পপোস্ট, ইলেকট্রিকের তার, কাদের মিয়ার মুদির দোকান, কাল্লু শেখের সরকারি গাঁজার দোকান। মাহাজন নাইক্যা, মাহাজন ঘুমাইছে- হের নাক ডাকানি শোনা যাচ্ছে- বাতাসে বহুদূর থেকে। আর পাথর আলী হাটে, রেলক্রসিংয়ের কাছে ওর শৈশব দাঁড়িয়েছিল- কালো বোরকা পরা মাকে সে চিনতে পারে, আধা জোছনায় বোরকার মুখে দুটো সাদা চোখ জ্বলছিল মা’র?

‘তরে লাইয়া আর পারি না, বাবা। তর মতন ছাওয়াল কিল্লাইগ্যা প্যাটে ধরছিলাম। কুনু কামও করবার পারস না। খাওনের বেলায় অত চিল্লাস ক্যা?’

পাথর আলীর ১১ বছরের শরীর নত হয়ে যায়। ‘মা, আমারে হোটেলের কামে দিয়া দাও, আমি খামু।’

‘হ খাইবি, খাইবি, আমারে খাইবি- আমার কইলজা গুরদা ব্যাবাক খাইবি।’ ভেতর থেকে পাক দিয়ে ওঠে অন্ননালি এবং পাথর আলীর ভীষণ খিদা পায়। ‘আমি খামু। খামু। আমারে খিলাও।’

মোহন মিয়া তখনই আসে, হাতে একটা গামলা এবং ভেঙে দেয় তার স্বপ্নকে। না চলে যায় স্মৃতির আবডালে। মায়ের কালো বোরকা দেখা যায় না।

‘পাথর আলী। অই পাথইর‌্যা...’ এই ডাক, একটা ¯েœহার্দ্র কণ্ঠস্বরের মতো ফিরে এসে তার রক্ত¯্রােতকে নিস্তব্ধ করে দেয়। সে একা একা কতক্ষণ এই রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল, আর কত দিন ধরে সে ভাত খায়নি, অন্ননালি শুকনো, খটখটে, মাহাজনের ক্যাশবাক্সের মতো- এসব ভাবনা এক নিমেষে চলে আসে। কিন্তু সে মোহন মিয়ার কোনো উত্তর দেয় না।

পাঁচ-ছয় হাত দূরে, মোহন মিয়ার ধারালো শরীরটা, হাতে একটা গামলা, আবার ডাক দেয়, ‘গলায় আওয়াজ নাই দেহি জানি। মইরা গ্যাছস।’ পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে মোহন মিয়া খুব কাছে। জ্যোৎ¯œায় রেললাইনগুলো ঝকমক করছে। তার মধ্যে মোহন মিয়া পাথর আলীকে হাত ধরে বসায়। একটা ইঁদুর নাকি চুয়া লাফ দিয়ে উঠে পালালো ঝোপের মধ্যে।

মোহন মিয়া গামলাটা নামায়। আধখোলা গামলা থেকে ঠান্ডা ভাতের সৌরভ, সব পরিবেশকে মুগ্ধ করে তোলে। মাহাজন আইজকা জানি কবাব রানছে- পাথর আলী এক মিনিট চোখ বন্ধ করে ভেবে নেয়, হোটেলের ক্যাশবাক্সের কাছে গোল গোল সব হাজার হাজার রুটি, রুটি আর জিলিপি- মাছি বসছে... একটা হাত দিয়ে মাছিদের তাড়িয়ে দিলো।

‘তুই একডা ব্যাক্কল, আস্তা ব্যাক্কল, মাহাজনের লগে গোসা করছ হারামজাদা। তুই কিল্ল্যা মাহাজনরে হাচা কথা কইতে গেলি, অ্যা-হারামজাদা।’ মোহন মিয়া টেনে টেনে বলে। সেই স্বর পাথর আলীর শরীরের চারপাশে একটা সূক্ষè জালের মতো ছড়িয়ে যায়। ভাতের কোমল গন্ধের স্বাদ নিতে নিতে সে উত্তর দেয়, ‘আমি কী করুম! মাহাজন আমারে পিটাইলো, আমার নাকশা ভাইঙ্গা দিলো, আমার...’

‘হ, বুজছি। তুই ব্যাটা চাল্লিগিরি করছস! রাখ, অহন ভাতটি খাইয়া ল।’ পাথর আলী আরো নুয়ে এলো, গামলার ঢাকনা খুলতেই সেই সৌরভ, সেই অপমান, ক্ষুধা এবং অভিমান, একসঙ্গে জেগে ওঠে। সে জিবকে লেলিয়ে দেয় ঠোঁটের কাছে, কষা দিয়ে রক্তের স্বাদ বেয়ে পড়ে- একটা হাত ঠান্ডা অনুভূতির মধ্যে ডুবে যায়। জিয়ল মাছের মাংস সাৎ সাৎ ধ্বনির সহযোগে তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসকে ঢেকে দেয়।

‘অস্তে অস্তে। ব্যাটা, খবিশের লাহান খাস ক্যা!’ মোহন মিয়া এই কথা বলে পকেট থেকে সিগারেট বের করে, ম্যাচের আলোতে তার গোঁফ প্রসারিত হয়ে এলো। ‘তর লাইগ্যা আরেকটা কাম ঠিক করছি, বুছছস- যোগাইল্যার কাম করবার পারবি?’ সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে ভাসিয়ে দেয় কথাগুলো।

পাথর আলী নিঃশব্দে ভাত গিলতে থাকে, তার চোয়ালের ওঠানামার দিকে তাকিয়ে অনেকটা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে মোহন মিয়া, ‘কী কই জবাব নাই ক্যা? ক্যা? পারবি?’

‘পারুম না।’ একটা ঢোঁক গিললো পাথর। ‘অরে শুয়োরের বাচ্চা, কাম না করলে খাইবা আমার ধন।’ প্রচ- শব্দে তোলপাড় করে ফেলে মোহন মিয়া। আর পাথর আলীর শরীর সংকুচিত হয়ে আসে, তার জিহ্বা অনেকখানি ভেতরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে এবং চেতনার মধ্যে আবার ধ্বনির প্রতিধ্বনি উঠছে, ‘খামু কী, খামু কী! খামু আমার মায়ের কইলজা, গুরদা।’ ক্ষীণকণ্ঠে তার অন্ত্রের নালিগুলো মাকে ডাকে, ‘বোরকা খুইলা আয়া পড় জলদি, অই মা, মাগো।’

খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে পাথর আলী লুঙ্গিতে মুখ মোছে, উঠে দাঁড়ায়। রেললাইন পেরিয়ে ঢালু রাস্তার পাশে ফেলে রাখা একটা ট্রাকের নিচে পাথর আলী সুড়সুড় করে ঢুকে পড়ে। তারপর মোহন মিয়া আস্তে আস্তে সিগারেটের আগুন ফেলে দিয়ে তার পিছে পিছে চলে আসে। এবার ট্রাকের নিচে দুটো শরীর পাশাপাশি হয়ে পড়ে। মোহন মিয়া একসময় হাত রাখল পাথর আলীর কাঁধে। ‘পাথর, অই পাথইর‌্যা, হুনছস!’ পাথর আলী উদাস হয়ে শ্বাস ফেলে একটা, মোহন মিয়ার শরীরের গন্ধ তখন তার ঘিলুর মাঝামাঝি এসে পৌঁছেছে। সব লোমকূপে শিরশিরে অনুভূতি ক্রমশ ডালপালা মেলে তাকে জড়িয়ে ধরে। তার কানের কাছে ফিশফিশ স্বরে বাজতে থাকে : ‘কাউলকা, বুজলি, কাউলকাই তরে যোগাইল্যার কামে লইয়া যামু। পাঁচ ট্যাকা দিবো, ইদ্রিস ওস্তাগারের লগে কথা হইছে। কাউলকা, কাউলকাই।’ পাথর আলী আস্তে আস্তে পাথর হয়ে যাচ্ছে, পেটের মধ্যে ছোট ছোট ঢেউ ওঠে, সে জ্যোৎ¯œাকে কোথাও দেখতে পায় না, বরং নিপাট অন্ধকার চারপাশে। মহাজনের হোটেলের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই সময় কমলাপুর স্টেশনের দিকে একটা রাতের মালগাড়ি ছুটে এলো, খাঁং খাঁং করে পাথর আলী একা অবসন্ন রাতের মধ্যে ডুবে গেল অন্ধকারের ¯্রােতে।

পাথর আলীর স্বপ্ন :

একটা একটা করে শৃঙ্খলিত দুয়ার খুলে যায়। একটা বিরাট গামলা শূন্যে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসে, সেখানে মোহন মিয়ার কল্লা, রক্তের ঝোলে ভেজানো। পাথর আলী একটু ঘৃণ্য দৃষ্টিতে দেখে এবং শুনতে পায়, ‘পাথর আলী, হপোন দ্যাখছস?’ কে বা কারা তার পেটের কাছে সুড়সুড়ি দেয়, ওইডা কী? সে বলে, লাটাই। গুডডি। ওইটা? রূপচাঁদা মাছের পেটি। আর এইডা, ওই যে ভাসতাছে বাতাসে, ওইডা হইলো গিয়া তর বাপের মাথা। মাহাজনের কণ্ঠস্বর মনে হলো এই সময়- সে আরো সামনে এগিয়ে যায় এবং দেখে মায়ের বোরকা পড়ে আছে, কালো ও নিঃসঙ্গ।

পাথর আলীর বাস্তব :

আজানের ধ্বনির মধ্যে ওর ঘুম ভাঙল, ভাঙা ট্রাক, এতোলবেতোল রাস্তা, ইটের পাজা ও কিছু উদীয়মান ঘাস- এই দৃশ্যের নিচে পাথর আলীর সর্বাঙ্গ জড়িয়ে শুয়ে ছিল মোহন মিয়া। কিছু ধোঁয়াকার আলো চারপাশে নামে, এই সময় এবং পাথর আলীর শরীরের আগাপাশতলা চুলকায়, খাজলির মতো বেদনা তার হৃদয়কে আলুথালু করে দেয়। শেষ রাতের হিমেল হাওয়া অনেকখানি নিচু দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। কাঁটা কাঁটা রোমের ওপর শীতল স্পর্শে সে মোহন মিয়ার বাঁধন খুলে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো।

মোহন মিয়ার ভরভরাটি মুখের দিকে তাকিয়ে সে একবার থুতু ফেলে, সারা শরীর চুলকায়। ভাতের গামলাটা পড়ে আছে মোহন মিয়ার মাথার কাছে। অহন কী খামু? সে কাউকে উদ্দেশ করে বলে, ‘আমারে কিছু খিলাও।’ সব অবসাদের মধ্যেও তার চিৎকার করতে ইচ্ছা করছিল, ‘আমি যাইতাছি মোহন বাই, আমি গেলাম।’ এই সময় প্রথম ট্রেনের শব্দ এলো, ঘ্যাস ঘ্যাস, তারপর ঘটাং ঘটাং- তার অনুভূতি মরে যায় এই শব্দে, মানুষটা জানি কেমুন আছিলো- রোজ রোজ আমারে ভাত খাওয়াইলো কিল্লইগ্যা? সবুজ ট্রেন স্পষ্ট হয়ে আসে, পাথর আলী রেললাইনের কাছে দাঁড়িয়ে যায়। কী আস্তে আস্তে ঝিক্কির ঝিক্কির করে এগিয়ে আসছে ট্রেন, যেন হাত বাড়ালেই থেমে যায়, আচ্ছন্নতার সীমান্তে দাঁড়িয়ে সবুজ তল্লাবাঁশের ঝাড় কাঁপছে। আশপাশ থেকে ঘরবাড়িগুলো সচকিত উত্তর দেয় ধ্বনি তরঙ্গের, আর পাথর আলী দৌড়াতে থাকে রেললাইন ধরে। ট্রেনটা খুব কাছে দিয়ে যাচ্ছে যখন, তখন মাথার ভেতর একটা কাচপোকা ঢুকে গেল সুরুৎ করে, আর পাথর আলী হাত বাড়াতেই ট্রেনের দরজা উঠে এলো- অন্ধকারের ভিতর মন চিক্খইর পারতাছে : কাউলকা তরে নয়া কামে লয়া যামু। পাথর আলী পেছনে তাকালে ট্রেনের গতি বাড়তে থাকে, একটার পর একটা টেলিগ্রাফ পোস্ট হাত নেড়ে বিদায় জানায়।

সে দূর থেকে দেখে মোহন মিয়া লুঙ্গির গিঁট লাগিয়ে চিৎকার দিচ্ছে, ‘পাথইর‌্যা, আইজকা তরে নয়া কামে লয়া যামু, পাথইর‌্যা...’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close