নিজস্ব প্রতিবেদক
যাত্রী কল্যাণ সমিতির গোলটেবিল
ঢাকার ৮৭ শতাংশ বাসেই বিশৃঙ্খলা
ঢাকার ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাসই নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। গণপরিবহনের নৈরাজ্য নিয়ে কথা বলা এই সংগঠনটি বলছে, বাসে বাসে রেষারেষি করে বেপরোয়া চলাচল ও পাল্লা-পাল্লির যত্রতত্র বাস থামানো, চলন্ত অবস্থায় মাঝপথে গতি কমিয়ে ঝুঁকি নিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো, যাত্রী নেওয়ার জন্য ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা এখন নিত্যদিনের চিত্র। গতকাল শনিবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের ‘সড়কে নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এই দাবি করেন।
বক্তারা বলেন, এসব কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন, প্রাণ হারাচ্ছেন যাত্রীরা। সাম্প্রতিক সময়ে বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় লিপ্ত দুইটি বাসের মাঝখানে হাত চাপা পড়ে সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেনের। এতে তাকে প্রথমে হাত হারাতে এবং পরে জীবনও হারাতে হয়। রাজীবের মৃত্যুর এই মর্মান্তিক ঘটনায় সারা দেশ গুমরে কাঁদলেও বেপরোয়া চালকরা নির্বিকার। প্রতিদিনই বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়কে ঝরছে গড়ে কমপক্ষে ৬৪টি তাজা প্রাণ। প্রতিদিন আহত ও পঙ্গুর তালিকায় যুক্ত হচ্ছে ১৫০ জনের বেশি মানুষ। আমাদের সড়ক ব্যবস্থাপনা, সড়কের শৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েছে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে সারা দেশে নিবন্ধিত ৩১ লাখ যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনিবন্ধিত, ভুয়া নাম্বারধারী ও অযান্ত্রিক যান মিলে প্রায় ৫০ লাখ যানবাহন রাস্তায় চলছে। এসবের ৭২ শতাংশ ফিটনেসহীন। চলাচলের প্রায় অযোগ্য। অন্যদিকে সারা দেশে ৭০ লাখ চালকের মধ্যে বিআরটিএ লাইসেন্স আছে মাত্র ১৬ লাখ চালকের হাতে। রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে বেপরোয়া চলাচল করে। ফলে এসব বাসের দুর্ঘটনায় কারো হাত, কারো পা, কারো মাথা বা কারো জীবন চলে যাচ্ছে।
সংগঠনের সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ সেলের তথ্য মতে, সারা দেশে জানুয়ারি ২০১৮ থেকে ২০ এপ্রিল ২০১৮ পর্যন্ত ১৭৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ১৮৪১ জনের প্রাণহানি হয়েছে এবং ৫৪৭৭ জন আহত হয়েছেন। পঙ্গু হয়েছেন ২৮৮ জন।
রাস্তায় শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং পথে পথে মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে সংগঠনটি ১০টি সুপারিশ তুলে ধরেছে। এগুলো হচ্ছে বাসে বাসে প্রতিযোগিতা বন্ধে একই রঙের কোম্পানিভিত্তিক বাস চালু করা, পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে ‘গণপরিবহন সার্ভিস অথরিটি’ টিম গঠন করা, ট্রাফিক বিভাগের কার্যক্রম জবাবদিহিতার আওতায় আনা, চালকের হাতে দৈনিক জমাভিত্তিক বাস ইজারা দেওয়া বন্ধ করা, বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা জনবান্ধব করা, সড়কে চাঁদাবাজি, টোকেন-বাণিজ্য, দখলবাজি, হকার ও অন্যদের ব্যবহার বন্ধ করা, ভাড়া-নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া এবং পরিবহনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যাত্রী সাধারণের অভাব-অভিযোগ তুলে ধরা ও মত প্রকাশের স্বার্থে যাত্রীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক, ডিটিসিএ’র সাবেক নির্বাহী পরিচালক গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া, বুয়েটের অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম তালুকদার প্রমুখ।
কাজী রিয়াজুল হক বলেন, মানবাধিকারের অন্যতম শর্ত মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের স্বীকৃতি ও বাস্তবায়ন। আমাদের সড়কে অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যের চাকায় এই অধিকার পিষ্ট হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে আইনের প্রয়োগ থাকলেও আমাদের এখানে প্রকৃতপক্ষে আইনের কোনো প্রয়োগ নেই।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এস এম সালেহ উদ্দীন আহমেদ বলেন, আমরা মেয়র আনিসুল হকের নেতৃত্বে কাজ করে একটি পরিকল্পনা সরকারের কাছে তুলে ধরেছি। এটি বাস্তবায়িত হলে গণপরিবহনের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা অনেক খানি দূর হবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি কায়েমী স্বার্থরক্ষার জন্য এই সমস্যাগুলো জিইয়ে রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন।
বুয়েটের অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, মাদকের হাত থেকে পরিবহন সেক্টরকে রক্ষা করা না গেলে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি আরো বাড়তে থাকবে।
ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া আইন না মানার প্রবণতাকে সড়কে নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী করে বলেন, যারা নিহত হন শুধু তারাই মারা যান না, এক অর্থে তার পুরো পরিবারটি মারা যায়।
"