মেহেদী হাসান

  ০৬ মে, ২০২৪

বন উজাড়, চড়ছে তাপ

ফুল-ফসলে ভরা মাঠ, সড়কের দুই পাশে গাছের সারি আজ দেখা যায় না। ১ হাজার ৩০০ নদী, নদীর ধারে পথ, পথের ধারে গ্রাম, সবুজ মাঠ, সবুজ বনও যেন উধাও হয়ে গেছে। সবুজ মাঠ গিলছে কংক্রিটের ভবন; দখল হয়ে যাচ্ছে নদী, নদীর ধারের পথটুকুও। এ অবস্থায় ২০৩০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্ধ বনের গাছ কাটা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবু বন উজাড় থামছে না। ফলে প্রতি বছরই তাপপ্রবাহের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন রক্ষায় সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে। প্রয়োগ করতে হবে আইন।

সূত্র বলছে, বনের জমি দখলের তালিকায় আছে ৮৮ হাজার ২২৫ ব্যক্তি ও সংস্থার নাম। বন দখল করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কল-কারখানা নির্মাণ করেছেন তারা। সম্মিলিতভাবে দখল করেছেন ১ লাখ ৩৮ হাজার একর সংরক্ষিত বন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২৮ জেলায় ১ লাখ ৬০ হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সারা দেশে ২ লাখ ৫৭ হাজার একর বনভূমি দখলের ফিরিস্তি তুলে ধরে ৫ হাজার পৃষ্ঠার নথিতে বনখেকোদের তথ্য সংসদীয় কমিটিকেও জানিয়েছে বন বিভাগ।

তথ্য বলছে, দখল হওয়া জমির ৫৯ হাজার ৪৭১ একর কক্সবাজারে। ঠিক একই পরিস্থিতি চট্টগ্রাম ও সিলেটেও। ২০২১ সালে সরকারের পক্ষ থেকে তথ্য-উপাত্ত হাতে নিয়ে বেশ আলোচনা ও হুমকি দেওয়া হলেও আজ পর্যন্ত বন্ধ হয়নি নির্বিচারে বন উজাড়, জমি দখল। জনসম্মুখে আসেনি দোষীদের নামও।

বন অধিদপ্তরের প্রতিবেদন মতে, সারা দেশে বনের জমির ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৫৮ দশমিক ৮৪ একর বেদখল হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬১৩ একর সংরক্ষিত বনের জমি। সংরক্ষিত বনভূমির দখলদার চিহ্নিত হয়েছে ৮৮ হাজার ২১৫ জন। সংরক্ষিত বাদে অন্য বনের জমি বেদখলে চলে গেছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৫৪৫ একর, যার দখলদার চিহ্নিত হয়েছে ৭২ হাজার ৩৫১ জন। অর্থাৎ বনের জমি বিভিন্নভাবে দখলে রেখেছেন ১ লাখ ৬০ হাজার ৫৬৬ জন। বনের এসব জমি দখল করে করা হয়েছে শিল্প-কারখানা, রিসোর্ট, বসতভিটা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আবার অনেক জায়গায় বনের জমি দখল করে করছেন চাষাবাদ। সরকারের সাবেক আমলা ও রাজনৈতিক পরিচয়ধারীদের নাম থাকায় বনের জমি উদ্ধার হয় না বলে মতামত বিশেষজ্ঞদের।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ৫ হাজার ৫৫৬ জন দখলদার ১৩ হাজার ৪৩৫ দশমিক ১৯ একর বনের জমি দখল করে হাটবাজার, কর্টেজ, রিসোর্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি স্থাপনা তৈরি করেছেন। ১ লাখ ১০ হাজার ৮৩৬ জন দখলদার ১ লাখ ৮ হাজার ৪৫৭ দশমিক ৮৯ একর জমি দখল করে ঘরবাড়ি তৈরি করেছেন। এ ছাড়া ৪৩ হাজার ৮৭৫ জন দখলদার ১ লাখ ৩৩ হাজার ৫৪৩ দশমিক ৬৭ একর বনের জমি দখল করে কৃষি, বাগান, চারণভূমি, লবণ চাষ ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করছে।

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার তথ্য বলছে, বন উজাড়ের সঙ্গে বৈশ্বিক তাপমাত্রাও ক্রমাগত বাড়ছে। গাছ বেড়ে ওঠার সঙ্গে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। কিন্তু যখন কোনো বন কেটে ফেলা হয় বা পুড়িয়ে ফেলা হয় তখন আর্দ্রতা কমে যায়; ফলে অন্য সব গাছপালা শুকিয়ে যায় এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে। বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগব্যাধি এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেইন ফরেস্ট শুকিয়ে আগুনের সূত্রপাত ঘটে এবং তার থেকে দ্রুত বনভূমি ধ্বংস হয়ে যায়। মানুষের পাশাপাশি বনভূমিতে বসবাসকারী প্রাণীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধির উৎপত্তি হচ্ছে।

সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন জানান, সুন্দর ও বাসযোগ্য ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় যেকোনো দেশের আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু দেশে বন বিভাগ নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২৩ লাখ হেক্টর; যা দেশের আয়তনের শতকরা ১৫ দশমিক ৫৮ ভাগ। আর বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ দেশের আয়তনের শতকরা ২২ দশমিক ৩৭ ভাগ। অবশ্য বনভূমি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সরকার তথা বন অধিদপ্তর গত ১৪ বছরে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, প্রতি হেক্টর জমিতে কমপক্ষে শূন্য দশমিক শূন্য ৫ হেক্টরে বিভিন্ন ধরনের গাছপালার সমাবেশকে বনভূমি বলে। তবে বাংলাদেশে পর্যাপ্ত বন না থাকায় সরকারের পক্ষ থেকে কয়েকটি পদক্ষেপের কথা বলা হয়। যার মধ্যে ২০০৯, ২০১০ থেকে ২০২১, ২০২২ অর্থবছর পর্যন্ত বাস্তবায়িত বিভিন্ন প্রকল্প এবং রাজস্ব বাজেটের আওতায় ম্যানগ্রোভসহ ১ লাখ ৯৩ হাজার ৪৫৩ হেক্টর ব্লক; ২৮ হাজার ৫১৮ সিডলিং কিলোমিটার স্ট্রিপ বাগান এবং বিক্রয় বিতরণের জন্য উত্তোলিত ১০৮৬ লাখ চারা বিতরণ ও রোপণ করা হয় বলে দাবি করা হয়।

এদিকে, বনের ভেতর রাস্তা বা অবকাঠামো নির্মাণ না করে বনকে সম্পদ হিসেবে দেখার অনুরোধ জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। এ ছাড়া সারা দেশে বৃক্ষরোপণের ওপর জোর দিতে বলেছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। তবে মন্ত্রীদের বক্তব্য কিংবা নির্দেশনায় গাছ লাগানো হলেও তা বেঁচে থাকে না। ফলে বনায়নের উদ্দেশ্য হয় বিফল।

তথ্য বলছে, কুলাউড়ার বন বিভাগের বরমচাল বিটকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল ১৯২৪ সালে। তার মানে সংরক্ষিত বন হিসেবে বন বিটটির বয়স ১০০ বছর। কাগজে-কলমে এ বিটের আয়তন ১ হাজার ৮৫০ একর। হতাশাজনক বিষয় হচ্ছে, এর মধ্যে বন বিভাগের দখলে আছে মাত্র ৩৫০ একরের মতো জমি। বাকি সব জমি স্থানীয় লোকজনের দখলে। এ নিয়ে আদালতে মামলা-মোকদ্দমা চললেও বন বিভাগ সেসব জমি ফেরত পায়নি।

বন অধিদপ্তর ২০১৮ সালে টেকসই বন ও জীবিকা প্রকল্পের (সুফল) মাধ্যমে সারা দেশে ৫১ লাখ গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশে সহযোগিতামূলক বন ও সুরক্ষিত এলাকা (পিএ) সহ-ব্যবস্থাপনার উন্নতির লক্ষ্যে সুফল প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জুলাই এ শুরু হয়েছিল। পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পে প্রায় ১ হাজার ৫০২ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়। এর মধ্যে ৩২ কোটি ৬২ লাখ টাকা সরকার দেবে এবং বাকি টাকা বিশ্বব্যাংক ঋণ হিসেবে দেবে। অথচ এই বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় হয়েছে বেশির ভাগই। চট্টগ্রামের উত্তর কাট্টলী উপকূলীয় এলাকায় ৩৭ হাজার ৫০০ ঝাউ গাছের বন থাকলেও বনকর্মীদের অবহেলায় সরকারের এই বনায়ন কর্মসূচি ব্যর্থ হয়েছে। মরে গেছে সব গাছ।

ঢাকার ২০ শতাংশ স্থানে গাছপালা থাকা উচিত হলেও আছে মাত্র ২ শতাংশে। তুলনামূলক এক চিত্রে দেখা গেছে, ঢাকার অদূরে সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ শতাংশ এলাকায় গাছপালা ও ২২ শতাংশে জলাভূমি। এ কারণে একই সময় ঢাকার চেয়ে সেখানকার তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থাকে। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রমনা পার্ক এলাকার তুলনায় ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকায় তাপমাত্রার থাকে ২ ডিগ্রি বেশি।

অথচ ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূপ্রাকৃতিক গঠনের কারণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাপমাত্রা বেশি থাকার কথা। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র থেকে মাত্র ৩২ কিলোমিটার দূরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেশির ভাগ সময় ৩ ডিগ্রি কম থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্ধেক এলাকাজুড়ে থাকা ২৭ হাজার গাছ ও প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এলাকায় থাকা জলাভূমি তাপমাত্রা কম থাকার পেছনে ভূমিকা রাখছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জসীম উদ্দিন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, দেশীয় প্রজাতির গাছ বাদ দিয়ে বিদেশি গাছে ভরে গেছে দেশ। বিদেশি গাছ নতুন পরিবেশে টিকতে পারছে না। গাছ লাগানোর সময় গাছের জাত, উপযুক্ত পরিবেশ, ম্যানেজমেন্ট ঠিকমতো হলো কি না, তা গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। এটা দেখা না হলে গাছ মারা যাওয়াটাই স্বাভাবিক। বন বিভাগের কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা গবেষকদের রাখা হয় না। তারা নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে। কাজেই ভুল ধরার মতো তেমন কেউ না থাকায় সমস্যাগুলো হচ্ছে। প্রকল্পের গাছগুলো সঠিক ম্যানেজমেন্টের অভাবে মারা যাচ্ছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close