অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী

  ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সমাজ ভাবনা

কিশোর গ্যাং : সমাজের অবক্ষয় ও করণীয়

সমাজে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। বর্তমানে নানা সামাজিক সমস্যাগুলো আমাদের মধ্যকার সৌহার্দ্য, সম্প্রতি, ঐক্য এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রধান উপাদানগুলো ক্রমেই গ্রাস করছে। সমাজ গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে। কার্যত সমাজের অচলায়তন ও অধঃপতনের ক্রমধারা আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ধাবিত করছে। যদি আমরা এখনই এটা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারি, বলাই বাহুল্য যে এর খেসারত অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি দিতে হবে। বলছি, নব্য মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা সমস্যা ‘কিশোর গ্যাং’ নিয়ে। এ সমস্যা এতটাই গুরুতর যে, প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন! সরকারপ্রধান সম্প্রতি মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে ‘ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি’ নিয়ে কিশোর গ্যাং মোকাবিলার আহ্বান জানিয়েছেন, যা প্রশংসার দাবিদার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তৎপরতা চালাচ্ছে কিন্তু তারপরও রোধ করা যাচ্ছে না।

অতীতে একটা সময়ে সমাজে শৃঙ্খলা রক্ষায় পরিবার ও স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের ভূমিকা ছিল। তারা কিশোরদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণে প্রশ্রয় দিতেন না। এখন মুরব্বিদের হারানোর জায়গাটি নিয়েছেন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সুবিধাবাদীরা। তারা কিশোরদের ব্যবহার করেন। ‘বড় ভাই’ নামে সমাজে পরিচিত তারা। যারা কিশোর গ্যাংয়ের নামে অপরাধ কার্যক্রম চালায়, চাঁদা তোলা এবং আধিপত্য বজায় রাখার জন্য কিশোরদের ব্যবহার করে। আবার এই অর্থের একটা অংশ কিশোরদের জন্য ব্যয় করা হয়। এই কিশোর অপরাধীরা পরে হয়ে যায় সন্ত্রাসী। তবে এই সন্ত্রাসীদের কোনো দল নেই, আছে বড় ভাইদের ছত্রছায়া।

সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য কিশোর গ্যাং পরিস্থিতির ভয়াবহতা জানান দিচ্ছে। পুলিশের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে একটি জাতীয় গণমাধ্যমে বলা হয়, সারা দেশে ১৭৩টি ‘কিশোর গ্যাং’ রয়েছে। বিভিন্ন অপরাধজনিত কারণে এদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৭৮০টি এবং এসব মামলায় প্রায় ৯০০ জন আসামি আছে। ঢাকা শহরে কিশোর গ্যাং রয়েছে ৬৭টি। ২০২২ সালের ওই প্রতিবেদন প্রকাশের দেড় বছর অতিক্রম করেছে। এ সময় আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। গত ১০ এপ্রিল, ২০২৪ চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের কবল থেকে ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে হামলার শিকার হন একজন চিকিৎসক এবং পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। অনুসন্ধানে দেখা যায়, চট্টগ্রাম নগরে ৫ থেকে ১৫ জন সদস্যের অন্তত ২০০ কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। নগর জুড়ে এদের সদস্যসংখ্যা কমপক্ষে ১৪০০। ২০২৩-এর জুলাই থেকে চলতি বছরে এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের প্রধানসহ ২০০ জনের বেশি গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-পুলিশ। বর্তমানে বিচারাধীন ২ হাজার ২৩২টি মামলার বেশির ভাগ কিশোর গ্যাং-সংক্রান্ত।

পুলিশের অনুসন্ধানের বাইরেও ঢাকায় আরো ১৪টি সক্রিয় কিশোর গ্যাং আছে। ২০২৩ সালে যাদের হাতে শুধু ঢাকাতেই ২৫ জন নিহত হয়েছে। ২০২২-২৩ দুই বছরে তাদের হাতে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে (ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ)। ঢাকার অদূরে সাভারেও কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বেড়েছে। চলতি বছর মার্চ মাসে সেখানে ৪টি খুনের ঘটনায় সরাসরি সংশ্লিষ্টতা মিলেছে কিশোর গ্যাংয়ের। অর্থাৎ এদের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৩ সালে রাজধানীতে সংঘটিত ২৫টি খুনের সঙ্গে কিশোর গ্যাংয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এদের বিভিন্ন অপরাধের মধ্যে রয়েছে- ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখলে ভাড়া খাটা, উত্ত্যক্ত করা, হামলা, মারধর ও খুন। হিরোইজম এবং আধিপত্য ধরে রাখতেও বিভিন্ন দলের মধ্যে সংঘর্ষ, বিবাদ ঘটে হরহামেশাই।

যেকোনো সমস্যা নিরসনে সেটার মূলে যাওয়াটা জরুরি। এই যে গ্রেপ্তার, মামলা ও অভিযান চালিয়েও কিশোর গ্যাং সংখ্যা কমছে না, বরং নতুন নতুন গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। এমনকি গ্রেপ্তারে সহায়তাকারীর ওপর অভিযুক্তরা কর্তৃক হামলার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এর কারণ উদ্ঘাটন করাটা এখন জরুরি। আমরা সমস্যাকে গুরুত্ব দিই ভালো কথা, কিন্তু সমস্যার গভীরে গিয়ে তা মূলোৎপাটনের উপায় বাতলে দেওয়ার সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি। উপরন্তু, কিছু সংবাদমাধ্যমে কিশোর গ্যাং অভিযুক্তদের ছবি ছাপিয়ে এবং টেলিভিশন চ্যানেলে ঘটনাগুলোর ভিডিও দেখানো হচ্ছে। এটা সমাধান কিংবা পরিস্থিতি মোকাবিলার যথাযথ উপায় নয়। এ ধরনের বিষয়গুলো প্রতিরোধে নিতে হবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা।

যেকোনো সামাজিক সমস্যায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে। এখন তথ্যপ্রযুক্তির অবাধপ্রবাহের যুগ। এ সময় শিশু-কিশোররা অনলাইনে অনেক কিছু দেখে, যার ভেতর নেতিবাচকতা বেশি এবং তারা সহজেই সংগঠিত হয়। শহরগুলোতে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নেই, সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। শরীরচর্চা, খেলাধুলার সঙ্গে সংস্কৃতিচর্চা থাকলে কিশোর-তরুণরা অপরাধ ও মাদক থেকে দূরে থাকে। আমাদের সেই ব্যবস্থা নেওয়াটা জরুরি। শিক্ষাব্যবস্থায় এ ধরনের বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। পথশিশু ও অভিভাবকহীনদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় এনে সুশিক্ষিত করতে প্রয়োজনী পদক্ষেপ নিলে সুফল মিলবে। কারণ, ভালো নাগরিক হতে তাদের শিক্ষা ও ভালো পরিবেশ দরকার। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা, যুব ও ক্রীড়া এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিতে পারে।

আমি নিজে ৪০ বছরের অধিক সময় ধরে ধূমপান ও মাদকবিরোধী কথা বলেই যাচ্ছি। একটা সময় বিষয়গুলো পাত্তা দেওয়া হতো না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভাবনা পাল্টে গেছে। দেশে তামাক উন্নয়ন বোর্ড থেকে ‘জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল’ এবং ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর’ গঠন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ বাস্তবায়ন এবং মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির ঘোষণা দিয়েছেন। সরকার মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে।

কিছু ছোট বিষয় থাকে কিন্তু, অল্প সময়ের মধ্যে ভয়াবহ মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ধূমপান ও মাদক গলার কাঁটা হয়ে গেছে কিশোর-তরুণদের জন্য। কিশোর গ্যাং অপসংস্কৃতি এবং প্রায় সব সামাজিক অপরাধের মূলেই রয়েছে মাদক, যার শুরুটা হয় মূলত ধূমপান থেকে। দেশে প্রায় ১ কোটি মানুষ মাদকাসক্ত রয়েছে, যাদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ তরুণ-কিশোর। অন্যদিকে, মাদকাসক্তির বড় কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে ধূমপান। ধূমপান হচ্ছে মাদকের রাজ্যে প্রবেশের মূল দরজা। এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের মধ্যে শতকরা ৯৮ ভাগই ধূমপায়ী এবং তাদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ বিভিন্ন অপরাধ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। সুতরাং ১ কোটি মাদকাসক্ত ব্যক্তি গ্যাং অপসংস্কৃতিকে উসকে দিতে পারে। ফলে মাদকের আমদানি যেমন বাড়বে, তেমনি মাদকাসক্তের সংখ্যাও ক্রমেই বৃদ্ধি পাবে।

যারা মাদকদ্রব্য সেবন করে তারা প্রথমে ধূমপানে অভ্যস্ত হয়, তারপর মাদকদ্রব্য সেবন শুরু করে থাকে। পরে তারা বিভিন্ন মরণ নেশায় আসক্ত হয়। বর্তমানে কিশোর-তরুণরা বন্ধুদের প্ররোচনায় ধূমপান শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে এর একটি বিরাট অংশ মাদক সেবন ও বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়ায়। বৈশ্বিকভাবেও বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত যে, তরুণ বয়সেই বেশির ভাগ তরুণ ছেলেমেয়ে কৌতূহলবশত বা পারিপার্শ্বিক প্ররোচনায় ভয়াবহ মাদক ও ধূমপানের নেশায় জড়িয়ে পড়ে। হয়তো-বা তার উপলক্ষ থাকে কোনো একটি বিশেষ দিন বা বিশেষ অনুষ্ঠান। হয়তো সেভাবে আজ শুধু আনন্দ ও ফূর্তি করব। কাল থেকে আর তামাক/মাদক খাব না, তওবা করব। আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনা অসংখ্য নেতিবাচক নজির তৈরি করেছে। মূলত, মাদক এমনই ক্ষতিকর একটি নেশা যেটা একবার নিলে বারবার নিতে ইচ্ছে করে। কৌতূহলবশত কিংবা প্ররোচনায় যে তরুণটি মাদকের জালে জড়িয়ে পড়ছে, তাদের ফেরানো কঠিন।

এমনিতেই তামাক ও মাদকের আগ্রাসনে তরুণরা বিপথগামী হয়ে পড়ছে। উপরন্তু, নাটক, সিনেমায়ও তরুণদের আইডল ও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা নায়ক, নায়িকাদের দ্বারা ধূমপানে, মাদকে উৎসাহিত করে এমন দৃশ্য অহরহ প্রচার করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সিগারেট কোম্পানিগুলোর বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেটের ব্যবহার বাড়ছে। যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে সেটা রীতিমতো উদ্বেগজনক! সুতরাং, বসে থাকার সময় নেই। তরুণদের রক্ষায় কাজ করতে হবে।

কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যে ভিন্ন দৃষ্টির কথা বলেছেন, সেটার একটা দিক হচ্ছে- প্রতিরোধ। যারা এই অপসংস্কৃতির সঙ্গে জড়ায়নি, তাদের দূরে রাখা এবং জড়িতদের শোধরানোর সুযোগ করে দেওয়া প্রয়োজন। সন্তান কার সঙ্গে মিশছে তার খোঁজ রাখা অভিভাবকদের অত্যাবশ্যকীয় কাজ সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখা এবং ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা, যা পরিবার থেকে একটি শিশুর ভিত্তি গড়ে দিতে সক্ষম। রাষ্ট্রীয়ভাবে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থার দিকে গুরুত্ব দেওয়া এবং তারুণ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারণ করা জরুরি। নীতি বাস্তবায়নে তাদের সার্বিক সম্পৃক্ততা ও সুফল নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আগামীর বাংলাদেশ এগিয়ে নিতে যোগ্য নেতৃত্বের শঙ্কা যেন না থাকে, সেদিকটায় আশু সুনজর দেওয়া অপরিহার্য। কিশোরদের মধ্যে ‘গ্যাং অপসংস্কৃতি’ দূর করতে হবে। এ জন্য শিশু-কিশোরদের মেধা ও সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক মনন বিকাশে পরিবার, সমাজ সরকারি সব পদক্ষেপের সঙ্গে আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। নতুবা এর পরিণাম থেকে আমরা কেউ মুক্ত থাকতে পারব না। তাই আসুন, আমরা এই অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে একসঙ্গে কাজ করি।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, (একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক,

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র), সম্মানিক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম ও অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close