ড. মো. গোলাম ছারোয়ার

  ২১ মার্চ, ২০২৪

মুক্তমত

ত্যাগই মানুষকে মহিমান্বিত করে

যিনি সৃষ্টি করেন, তিনি কখনোই অন্যের অনিষ্টের কথা চিন্তা করতে পারেন না। সৃষ্টিকুলের সেরা মানব সৃষ্টির পর থেকেই সঠিক পথে পরিচালিত হওয়ার জন্য সব সময় ঐশী বাণীযুক্ত নির্দেশনা অবতীর্ণ হয়েছে। মানবতা ও মানবিক মূল্যবোধ এতটাই প্রয়োজন যে, তা না হলে সম্প্রীতিমূলক সামাজিক ব্যবস্থার সবই নিঃশেষ হতে বাধ্য। এ মানবিক মূল্যবোধের মাধ্যমেই রচিত হয় মানুষের ভালোত্ব। ভালো চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি হলো সুগন্ধির মতো। এর সুবাস ছড়িয়ে পড়ে সমাজের সর্বত্র। উপকৃত হয় সবাই।

শুরু হয়েছে মুসলিম উম্মাহর এক বিশেষ প্রাপ্তি ও মহান হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ পবিত্র মাহে রমজান। রমজান মাসের পবিত্রতা মানেই মানবকল্যাণ। মাহে রমজানের শিক্ষা মানেই ত্যাগের মাধ্যমে কল্যাণ ও শান্তি লাভ করা। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সিয়াম সাধনা মানেই হলো নিজেকে সব ধরনের অনিষ্ট কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখা। আমরা এমন কিছু কাজ করতে পারি, যা লোকচক্ষুর অন্তরালে। সবাইকে ফাঁকি দিয়ে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। ইসলামের অন্যান্য মৌলিক কার্যক্রমের মধ্যেই আমরা অনেক সময় ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ প্রলোভন দেওয়ার জন্য তো আমাদের নফসে আম্মারার শক্তিশালী প্ররোচনা রয়েছে। কিন্তু সিয়াম সাধনা এমন একটি সাধনা, এমন এক ধ্যানকর্ম, যেখানে লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়েও কোনো কিছু খাওয়া বা পান করা তো দূরের কথা, চিন্তাও করা যায় না। পবিত্র গ্রন্থ আল-কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, রোজার মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন, অর্থাৎ পরহেজগারি করা। প্রতিক্ষণে আল্লাহর ভয় অন্তরে সৃষ্টি করার নামই তাকওয়া। আর এটা অর্জনের জন্য প্রয়োজন ত্যাগ। ভোগে কখনোই এমন মহান অর্জন সম্ভব নয়। ত্যাগ কীভাবে হবে সে বিষয়ে একটু আলোচনা করছি। বৃহৎ প্রাপ্তি সামনে রাখলে ক্ষুদ্র প্রাপ্তিকে ত্যাগ করা অনেক সহজ হয়ে পড়ে।

ক্ষুদ্র আর বৃহৎ প্রাপ্তির মধ্যে পার্থক্য করতে পারাটা একটা বিশেষ অর্জন। এ অর্জন অর্জিত হয় শিক্ষা ও পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতা আর বিচক্ষণতা থেকে। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। যে অর্জনে তেমন কোনো বেগ বা ত্যাগের প্রয়োজন হয় না, যে অর্জনের স্থায়িত্বও বেশি নয়, তা অতি সহজেই অর্জিত হয়। আর যে অর্জনে অনেক সাধনা, কষ্ট, চেষ্টা, ত্যাগ, লাঞ্ছনা, বাধা-বিঘ্ন, বিপত্তি অতিক্রম করতে হয়, তার স্থায়িত্ব ও প্রাপ্তি দুটিই চিরস্থায়ী। যেমন- খাদ্যে ভেজাল দেওয়া, লোক ঠকানো, মজুদদারি, অধিক মুনাফা লাভের আশায় কৃত্রিম সংকট তৈরি, চুরি, ছিনতাই, ঘুষ ইত্যাদি মাধ্যমে আয় করা খুবই সহজ; কিন্তু তা ক্ষণস্থায়ী। কারণ যে একজনকে ঠকাবে, সে তার চেয়ে বড় একজনের কাছে অবশ্যই ঠকবে। এভাবে ঠকা আর ঠকানোর দুষ্টচক্র চলতে থাকলে পুরো সামাজিকব্যবস্থা হয়ে পড়ে ভঙ্গুর, হয়ে পড়ে অস্থির ও কলুষিত। অন্যপক্ষে নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য পুরোটাই স্বচ্ছতার মাধ্যমে, সব নিয়মণ্ডকানুন, বিধিনিষেধ মেনে অর্থ উপার্জন করা অবশ্যই পরিশ্রম ও নিষ্ঠাসাপেক্ষ। এর জন্য প্রয়োজন ত্যাগ, নিষ্ঠা, মানবতা, মানবিকতা, সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা, আর স্রষ্টার প্রতি ভয়ের এক পবিত্র কৃষ্টি। এ কৃষ্টি সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ। আর আমরা জানি, সব প্রশিক্ষণই পরিশ্রমসাপেক্ষ। এ প্রশিক্ষণ যদি হয় ন্যায়-নিষ্ঠা, সততা আর আন্তরিকতার সঙ্গে, তাহলে অবশ্যই তার অর্জনও হবে চিরস্থায়ী।

মুসলিম উম্মাহর জন্য পুরো রমজান মাসই এক চরম ত্যাগের মাধ্যমে মহিমান্বিত হওয়ার অপার সুযোগ। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত না খেয়ে থাকলে বৈজ্ঞানিকভাবে শরীরবৃত্তীয় সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন সচল হয়ে ওঠে, তেমনি সমাজের নিম্নবিত্ত ও অভাবী মানুষের অভাবের তাড়নায় ক্ষুধাজনিত কষ্ট ও দুর্ভোগের অনুভূতি হৃদয়ঙ্গম করার বিরাট সুযোগ তৈরি হয়। একইভাবে প্রশিক্ষণ হয় হাতের, পায়ের, চোখের, মুখের, অন্তরের ও মস্তিষ্কের। অর্থাৎ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের। কারণ পবিত্র মাহে রমজানে সিয়ামরত অবস্থায় হাত দিয়ে কারো অনিষ্ট করা যাবে না। এর অর্থ, হাত দিয়ে কোনো ভেজাল বা বিষাক্ত দ্রব্যখাদ্যের সঙ্গে মেশানো যাবে না, হাত দিয়ে কোনো অবৈধ কিছু সই করা যাবে না, কাউকে ঠকানো যাবে না, কাউকে মারধর ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করা যাবে না। একইভাবে দুই পা দিয়ে কোনো অনিষ্ট কাজে অংশগ্রহণ করা যাবে না। একই ধারাবাহিকতায় মুখ, চোখ, মস্তিষ্ক- সবকিছুই আল্লাহপ্রদত্ত বিধিবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হবে। এসব কার্যক্রমে অবশ্যই ত্যাগের প্রয়োজন। অর্থাৎ প্রাপ্ত ও অর্জিত ধন-সম্পদও আল্লাহপ্রদত্ত কানুন দ্বারা ব্যবহৃত হবে, যা ত্যাগের এক অনন্য উদাহরণ।

ইফতারে এক সেকেন্ড আগেও যেমন কেউ একবিন্দু পানিও খেতে পারবে না, কারণ এটাই আল্লাহর বিধান, তেমনি উপরোল্লিখিত সব কার্যক্রমও একই বিধানের অন্তর্গত। তাই আসুন, সব অনাচার, পাপাচার ও অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখার জন্য মানবতার মহান ব্রত নিয়ে এক মাস সিয়াম সাধনার প্রশিক্ষণে সবাই প্রশিক্ষণার্থী হই। আল্লাহপাক সবার রোজা কবুল করুন।

লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close