আসাদুজ্জামান চৌধুরী সম্রাট

  ০১ মার্চ, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

নতুন শিক্ষাক্রম : বাস্তবায়নের বহুবিধ প্রতিবন্ধকতা

শিক্ষা হলো একটি দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন ও উন্নত জাতি গঠনের মূল চাবিকাঠি। শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষাক্রম শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ‘শিক্ষাক্রম’-এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Curriculum. কারিকুলাম শব্দটি লাতিন শব্দ Currere থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘দৌড়ানোর নির্দিষ্ট পথ’। সাধারণত শিক্ষাক্রম বলতে বোঝায় নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা। লাগামহীন ঘোড়া যেমন নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না, ঠিক তেমনই সঠিক শিক্ষাক্রম ছাড়া কাঙ্ক্ষিত নাগরিক গড়ে তোলা যায় না। বলাবাহুল্য, মানসম্পন্ন এবং আধুনিক শিক্ষাক্রম ছাড়া উন্নত দেশ ও জাতি গঠনের আশা অরণ্যে রোদন ছাড়া আর কিছু নয়।

বাংলাদেশে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে ২৬ জুলাই ১৯৭২ সালে সর্বপ্রথম ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন’ গঠিত হয়। পরে ১৯৭৬, ১৯৮৩, ১৯৮৭, ১৯৯৭, ২০০১, ২০০৩ এবং ২০১০ সালে দেশের শিক্ষাক্রম সংস্কার করা হয়েছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার এই কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানমুখী না হয়ে দিন-দিন সনদপত্রমুখী হয়ে পড়ছে, যার দরুন শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিচিন্তা, দর্শনচিন্তা, পরিবার, সমাজ ও পরিবেশ নিয়ে চিন্তাভাবনার সক্ষমতা একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রয়েছে। তদুপরি বর্তমান চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে আমাদের পুঁথিগত প্রচলিত শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞানকে প্রক্রিয়াজাত করে একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার সাধনায় শিক্ষার্থীরা ব্যর্থ হচ্ছে। তাই বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সালে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২২ পরীক্ষামূলকভাবে প্রণয়ন করেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে জীবন-জীবিকা নির্বাহীকরণ, স্থানীয়-বৈশ্বিক অভিবাসন, ঝউএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, উন্নতিশীল দেশে উত্তরণসহ ইত্যাদি বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত নতুন কারিকুলাম প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন বর্তমান সরকার। বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এবং বর্তমান বিশ্বে নিজেকে খাপ খাওয়াতে এই নতুন শিক্ষাক্রমটি ইতিমধ্যে চালু করা হয়। নতুন শিক্ষাক্রমের মূল লক্ষ্য হলো : পারস্পরিক সহযোগিতা-সহমর্মিতা, সহাবস্থান নিশ্চিত এবং বৈষম্যহীন সমাজ, সুখী ও সমৃদ্ধিশালী এবং ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা। মানবসম্পদ উন্নয়ন ও উন্নত জাতি গঠনের লক্ষ্যে সরকার যোগ্যতাভিত্তিক নতুন এই শিক্ষাক্রমটি ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে চালু করেন। এই বছর থেকে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সালে চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলামটি কার্যকর করা হবে। নতুন শিক্ষক্রমে পাঠদান পদ্ধতি, মূল্যায়ন ও পাঠ্যপুস্তকের আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে।

শিক্ষা-গবেষকদের মতে, এই শিক্ষাক্রমটি পদ্ধতিগতভাবে ভালো। কিন্তু বাস্তবায়নে রয়েছে বহুবিধ প্রতিবন্ধকতা। উল্লেখ্য, নতুন পাঠ্যক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক এবং বিষয়ভিত্তিক দক্ষ ব্যক্তি প্রযোজন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে এই দুই ক্ষেত্রেই রয়েছে ব্যাপক ঘাটতি। যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম থাকা অন্য দেশগুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত খুবই কম। কিন্তু আমাদের দেশে শ্রেণিভেদে এ অনুপাত অনেক বেশি। সর্বশেষ ‘বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান-২০২১’ অনুযায়ী সরকারি স্কুল ও কলেজপর্যায়ে একসঙ্গে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৪১, প্রাইভেট পর্যায়ে ১:২৯, আবার শুধু পাবলিক কলেজে ১:৫৩ এবং প্রাইভেট পর্যায়ে ১:৩৭। এ ছাড়া জরিপে দেখা গেছে, দেশের মাদরাসা পর্যায়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:২৪, একইভাবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ অনুপাত ১:৫৮ এবং প্রাইভেট পর্যায়ে ১:২২। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের আদর্শিক মান হলো ১:২০। অথচ আমাদের দেশের কোনো ক্ষেত্রেই এই অনুপাত বজায় থাকা তো দূরের কথা, কাছাকাছি পর্যন্ত নেই বললেই চলে, যা নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য অন্যতম একটি প্রতিবন্ধকতা। লক্ষণীয়, আমাদের অধিকাংশ বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক অদক্ষ এবং খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে পাঠদান করানো হয়, যা ‘যোগ্যতাভিত্তিক’ নতুন পাঠ্যক্রম কার্যকরের আরেকটি অন্তরায়।

বাংলাদেশের সিংহভাগ শিক্ষাঙ্গনে বর্তমানে অস্থিতিশীল শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতি দৃশ্যমান। এ রকম রাজনীতির ফলে শিক্ষাঙ্গনে সৃষ্টি হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষকের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব এবং দলীয় কোন্দল। পাশাপাশি রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন-রাহাজানি, ধর্ষণ, ছিনতাইসহ ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। যার দরুন মাঝেমধ্যে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রের হাতে হেনস্তা এবং খুন হচ্ছেন দেশের শিক্ষকরা। শুধু তা-ই নয়, মাঝেমধ্যে শিক্ষকের কাছে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে ছাত্রীরা। শিক্ষাঙ্গনের এসব নৈরাজ্যকর পরিবেশে নতুন কারিকুলাম সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা অসম্ভব।

অপর্যাপ্ত বাজেট এবং মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতাও প্রস্তাবিত নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের আরেকটি প্রতিবন্ধকতা। ইউনেসকোর মতে, একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হলো জিডিপির (দেশজ উৎপাদন) ১.৭৬ শতাংশ। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ‘প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়’ এবং ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়’-এর আওতাধীন। লক্ষণীয়, এই দুই মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট শিক্ষা অধিদপ্তর এবং বোর্ডগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। ফলে অনেক শিক্ষকের জন্য আধুনিক এবং মানসম্মত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয় না। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ-বাণিজ্য, ফান্ড কেলেঙ্কারি ও বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদে অযোগ্য এবং স্বল্প শিক্ষিত লোকবল নেওয়া, শ্রেণি কার্যক্রমের বরাদ্দ করা স্বল্প সময়, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম এবং ডিজিটাল মাধ্যমে পাঠদান পদ্ধতির অপ্রতুলতা, চাহিদা অনুযায়ী শ্রেণিকক্ষের অভাব, আসন-সংখ্যার বাইরে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তিগ্রহণ, শিখন-উপকরণের অপর্যাপ্ততা এবং উচ্চমূল্যসহ প্রভৃতি সমস্যাগুলো নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের অন্যতম অন্তরায়।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এসব সমস্যা ও অপ্রকৃষ্ট পরিস্থিতির মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা আদৌ কি সম্ভব?

তাই সরকারকে নতুন শিক্ষাক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান সর্বস্তরের সমস্যাগুলো দ্রুত নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য বিষয়ভিত্তিক পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের বেতন ও পদমর্যাদা বৃদ্ধি এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে দ্রুত পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। তদুপরি শিক্ষকদের জন্য আধুনিক ও মানসম্মত প্রশিক্ষণ কর্মশালার ব্যবস্থা করা উচিত। শিক্ষা খাতে বার্ষিক অর্থ বাজেটে জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং গবেষণা খাতকে প্রাধান্য দিতে হবে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর এবং শিক্ষা বোর্ডগুলোর মধ্যে সমন্বয় আনতে হবে। পাশাপাশি সরকারকে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুর উদ্যোগ না নিয়ে, দেশে বিদ্যমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চাহিদানুসারে শ্রেণিকক্ষের জন্য ভবন নির্মাণের ব্যবস্থা করা উচিত। এ ছাড়া শ্রেণিকার্যক্রমে বরাদ্দ করা সময় বৃদ্ধি এবং মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে বাজারে শিখন-উপকরণের সব পণ্যের মূল্য সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের আয়ের সক্ষমতার মধ্যে আনতে হবে। তা ছাড়া শিক্ষাঙ্গনে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ আনয়ন অথবা রাজনীতি সাময়িক বন্ধের জন্য কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে সরকারের পাশাপাশি শিক্ষকদের কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের উচিত মানসম্মত পাঠদানের মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে সিলেবাস সম্পন্ন করা এবং বিদ্যালয় ছাড়া প্রাইভেট অথবা কোচিং ক্লাসে সংশ্লিষ্ট না থাকা। শুধু তা-ই নয়, শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক আয়োজিত সব প্রশিক্ষণে নির্দ্বিধায় অংশগ্রহণ এবং বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের জন্য যোগ্য এবং উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের নির্বাচন করতে হবে। তা ছাড়া শিক্ষকদের শিক্ষাঙ্গনে নিজের অতি আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে নোংরা রাজনীতি ও গ্রুপিং করা অনুচিত। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-সংক্রান্ত যেকোনো সমস্যা দূরীকরণের জন্য স্থানীয় প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে নির্ভয়ে শরণাপন্ন হতে হবে।

সর্বোপরি বলা যায়, বাংলাদেশে সদ্য চালুকৃত নতুন শিক্ষাক্রমটি পদ্ধতিগতভাবে ভালো হলেও বাস্তবায়নে রয়েছে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের বাস্তবতায় এসব সমস্যা শিগগিরই সমাধান করা যদিও অসম্ভব, তবু নতুন শিক্ষাক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এবং শিক্ষাঙ্গনের বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধান করা একান্ত জরুরি। অন্যথায় একবিংশ শতাব্দীতে এ শিক্ষাক্রমটি নামমাত্র বাস্তবায়িত হবে, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন কখনো সম্ভব হবে না।

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close