মো. খসরু চৌধুরী
মুক্তমত
মাতৃভাষার জন্য আত্মদানের নজির বিশ্বে আর নেই
মহান ভাষা আন্দোলন রোপণ করেছিল স্বাধীনতার বীজ। মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রক্ত দিয়েছিল সালাম, বরকত, রফিক, শফিক বাংলা মায়ের সেরা সন্তানরা। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই বিকশিত হয় বাঙালির স্বাধিকার চেতনা। যার চূড়ান্ত রূপ সত্তরের নির্বাচনে অবয়ব পায়।
মাতৃভাষার জন্য আত্মদানের এমন নজির বিশ্বে বোধকরি আর নেই। রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে একুশের প্রভাব এতটাই সর্বব্যাপী যে, ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। আত্মপরিচয়-বিস্মৃত বাঙালি জাতিকে স্বরূপের সন্ধান দিয়েছে মহান একুশ। জাতি হিসেবে একতাবদ্ধ করেছে যেমন, তেমনি জুগিয়েছে অপরিমেয় শক্তি ও সাহস। অদম্য আত্মবিশ্বাসে করেছে বলীয়ান।
একুশের পথ ধরে তাই ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান পেরিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি পেয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম ভাষাভিত্তিক একটি দেশ। বাঙালি ও বাংলাদেশ যত দিন থাকবে বিশ্বের বুকে, তত দিন থাকবে অমলিন বাংলা ভাষা ও অমর একুশে। কারণ, একুশের শেকড় প্রোথিত বাঙালির চেতনার গভীরে। একুশ বাঙালিকে অন্যায়, অবিচার ও অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে। এ দেশের মানুষ কখনোই সামরিক ও স্বৈরশাসনের কাছে মাথা নত করেনি। আপস করেনি গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে। আর এসবেরই প্রেরণা হয়ে আছে মহান একুশে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সে অবিনশ্বর চেতনা বাঙালির জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জন করেছে। ভাষাশহীদদের এ দিনটি এখন জাতিসংঘের উদ্যোগে সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়। দুনিয়ার দেশে দেশে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার সমুন্নত রাখার শপথ নেওয়া হয় এ দিনে। মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার যে একটি মানবাধিকার তাও স্বীকৃত এখন আন্তর্জাতিকভাবে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানে ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বাঙালি মুসলমানরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু অচিরেই ভারত থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা উর্দুভাষী রাজনীতিক, আমলা ও সেনাপতিদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে পাকিস্তান। দেশের শতকরা পাঁচ ভাগ মানুষ উর্দুভাষী না হলেও তারা সে ভাষাকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার ধৃষ্টতা দেখায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতেও অস্বীকৃতি জানায় পাকিস্তানের ক্ষমতা কুক্ষিগতকারী শাসকরা। ছাত্রসমাজ এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে পাকিস্তানি পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। একুশের শহীদদের রক্তদান বাঙালি জাতিকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সাহস জুগিয়েছে। এ সাহসই ছিল ১৯৭১ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের অনুপ্রেরণা। মহান মুক্তিযুদ্ধেও তা পথপ্রদর্শক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সচেতনভাবে বাঙালির কাছ থেকে ভাষার অধিকার হরণ করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল সংখ্যালঘু জনগণের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে। কিন্তু তাদের সেই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন বাঙালির ত্রাণকর্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজীবন মাতৃভাষাপ্রেমী এই মহান নেতা ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্বে, ১৯৪৮ সালে রাজপথে আন্দোলন ও কারাবরণ, পরে আইনসভার সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অতুলনীয় ভূমিকা রাখেন। এক কথায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় অংশগ্রহণ ইতিহাসের অনন্য দৃষ্টান্ত।
বাংলা ভাষার দাবি বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল। রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবির আন্দোলনে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রথম গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ দেশে প্রথম সফল হরতাল। এই হরতালে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দেন। তাকে লাঠিপেঠাও করা হয়। পরে বঙ্গবন্ধুসহ বেশ কয়েকজনকে কারাগারে নেওয়া হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জেলে থাকার কারণে সক্রিয় আন্দোলনে অংশ নিতে না পারলেও আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছিল তারই নির্দেশনা ও পরামর্শে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় প্রত্যাবর্তন করার পর সরাসরি ভাষা আন্দোলনে শরিক হন। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সমকালীন রাজনীতিবিদসহ ১৪ জন ভাষা বীর সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনসহ অন্যান্য দাবি-সংবলিত ২১ দফা দাবি নিয়ে একটি ইশতেহার প্রণয়ন করেছিলেন। ওই ইশতেহারে ২১ দফা দাবির মধ্যে দ্বিতীয় দাবিটি ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। ঐতিহাসিক এই ইশতেহারটি একটি ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল, যার নাম ‘রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার-ঐতিহাসিক দলিল।’ ওই পুস্তিকাটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত। এই ইশতেহার প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং তিনি ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরদাতা।
বঙ্গবন্ধু একুশে ফেব্রুয়ারির সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ দিয়েছিলেন, যার হাত ধরে পরে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সাল থেকেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন।
পরিশেষে বলছি, বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাকে বুকে লালন করতে হবে। সর্বস্তরে বাংলা প্রতিষ্ঠার দায় পূরণেও উদ্যোগী হতে হবে। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের হার না মানা চেতনাকে সঙ্গী করে দেশ গঠনে ব্রতী হলে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন সম্ভব হবে।
লেখক : সংসদ সদস্য ঢাকা-১৮, সদস্য, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক,
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ
"