ড. মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি

  ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

ভাষা আন্দোলন ও ‘বাংলা বিভাগ’

১৯৫৩-১৯৫৪ সাল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যলয়ের বাংলা বিভাগের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়েই প্রতিষ্ঠিত হয় করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের দায়িত্ব নেন সৈয়দ আলী আহসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুহম্মদ আবদুল হাই। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপকরূপে যোগদানের পর দুজনেই ১৯৪৯ সালে বাংলা বিভাগে যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে অবসর গ্রহণের পর ড. শহীদুল্লাহ্ হাল ধরেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের। তার স্থলাভিষিক্ত হন মুহম্মদ আবদুল হাই- ১৯৫৪ সালের ১৬ নভেম্বর বাংলা বিভাগের রিডার ও বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব নেন মুহম্মদ আবদুল হাই। অন্যদিকে ১৯৫৪ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে রিডার ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগ দেন তারই সহকর্মী সৈয়দ আলী আহসান। দেশ ভাগ ও দাঙ্গার পটভূমিতে কিছু শিক্ষকের দেশত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে এই তিনজন বাংলা বিভাগে আসেন। নতুন জীবন লাভ করে পুনর্গঠিত বাংলা বিভাগ। ভাষা আন্দোলনের পরই তিনটি প্রধান শহরে তিন অধ্যক্ষের নেতৃত্বে শুরু হয় বাংলা বিভাগের বিকাশের কাল। পূর্ব থেকে পশ্চিমে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলেজে ঘটে এর বিস্তার।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সৈয়দ আলী আহসান এবং মুহম্মদ আবদুল হাই- এই তিন ভাষাপ্রেমিককে বলা যায় বাংলা বিভাগের ট্রায়ামভায়রেট। তারা বাংলা বিভাগের প্রধান স্বাধীন কেন্দ্র স্থাপন করেন ঢাকায়, সম্প্রসারিত কেন্দ্র স্থাপন করেন রাজশাহী ও করাচিতে। আলো স্থির ছিল কেন্দ্রে, এবার বিচ্ছুরিত হলো তার প্রভা নতুন দিগন্তে। এ সময়টা ছিল যুক্তফ্রন্টের সরকার গঠনের সময়। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর ১৯৫৪ সালের ৮-১২ মার্চ সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয় ২ এপ্রিল। এটি বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠারও সূচনাকাল। এ সময়েই ১৯৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষে ড. শহীদুল্লাহ প্রেরণায় মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনার প্রকল্প গ্রহণ করেন। এ প্রকল্প রচনার কারণ- অতীতের ইতিহাস রচনার অসম্পূর্ণতা দূর করা। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-সংক্রান্ত তার প্রবন্ধগুলো দুখণ্ড বাংলা সাহিত্যের কথায় সংকলিত হয়। তার মধ্যে প্রথম খণ্ড প্রাচীন যুগ প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে। ১৯৫৪ সালে বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত রচনা করেন যুগ্মভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ মুহম্মদ আবদুল হাই এবং করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ সৈয়দ আলী আহসান। একে বলা যায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের ট্রিলজি।

এ রকমই আরেকটি প্রকল্প তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বাংলা বিভাগের গঠন ও পুনর্গঠন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে আবদুল হাইয়ের যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলামনস্ক শিক্ষকদের নতুন যুগ শুরু হয়। পনেরো বছর ধরে তার নেতৃত্বে শিক্ষকতা, গবেষণা, সাংস্কৃতিক কর্মধারার ক্ষেত্রে নতুন উদ্দীপনার সঞ্চার হয় বিভাগে। তারই প্রচেষ্টায় মুনীর চৌধুরী ইংরেজি বিভাগ ছেড়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৪-৫৫ থেকে ১৯৫৮-৫৯ সালের মধ্যে গবেষণা সংগঠকরূপে আবদুল হাই অসাধারণ সাফল্য লাভ করেন। আগে বাংলা বিভাগ থেকে পিএইচডি পর্যায়ে কোনো গবেষণা ছিল না। নীলিমা ইব্রাহিম, আশুতোষ ভট্টাচার্য, আনিসুজ্জামান, গোলাম সাকলায়েন, আহমদ শরীফ এবং ওয়াকিল আহমদ উচ্চতর গবেষণা করেন তার সময়ে এবং তারই তত্ত্বাবধানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবদুল হাই প্রকাশ করেন অর্ধবার্ষিক সাহিত্য পত্রিকা ১৯৫৭ সাল থেকে; প্রথমবর্ষ প্রথম সংখ্যার প্রথম লেখাটি ছিল মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘বৌদ্ধ গানের ভাষা’।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হন ড. জুবেরী ১৯৫৩ সালের ৭ জুন। একসময়ের সহকর্মীর আমন্ত্রণে ড. শহীদুল্লাহ যোগ দেন বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে অধ্যক্ষরূপে ১৯৫৫ সালের ১ ডিসেম্বর। সেই সঙ্গে কলা অনুষদের অধ্যক্ষের দায়িত্বও গ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনের বছর ড. ইসরাত হোসেন জুবেরী (১৯১০-১৯৬৪) ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের প্রধান ও কলা অনুষদের ডিন। ড. শহীদুল্লাহ অনুপস্থিতিতে বায়ান্নর ছাত্রহত্যার নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণের সভায় শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন ড. জুবেরী। উভয়কেই বলা যায় ভাষা আন্দোলনের আদি তাত্ত্বিক। ১৯৪৭ সালের ২৯ জুলাই উভয়েই কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে বাংলা ভাষাকে জাতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাব করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা যায় ভাষা আন্দোলনেরই ফসল। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই প্রতিষ্ঠাতা মাদার বক্স ও জুবেরী উভয়েই ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি হয় বঙ্গভঙ্গ রদের পর ‘এক চমৎকার রাজকীয় ক্ষতিপূরণ’, তাহলে বলতে হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হলো ভাষা আন্দোলনের অনিবার্য ফল। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ হয়ে শুধু স্বতন্ত্র বাংলা বিভাগই উপহার দেননি, বাংলায় অনার্স ও এমএ কোর্সও প্রবর্তন করেন। তেমনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রথম অবস্থায় অনার্স ছিল না। সেখানে পিএইচডি গবেষণারও সূত্রপাত করেন তিনি। তার তত্ত্বাবধানে ১৯৫৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে হেয়াত মামুদ শীর্ষক গবেষণার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন মযহারুল ইসলাম। এটাই বাংলাদেশের প্রথম পিএইচডি।

পাকিস্তানের রাজধানীতে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫১ সালের জুন মাসে; বাংলা বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৩ সালে। স্মরণযোগ্য, ভাষা আন্দোলনের পরের বছর উর্দুর প্রাণকেন্দ্র করাচিতে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা বিভাগ। সে সময় করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন আবুবকর আহমদ হালিম (১৯৫১-৫৭)। বিভিন্ন সময়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন সৈয়দ আলী আহসান, মুহম্মদ ফারুক, সৈয়দ আলী আশরাফ, এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরী প্রমুখ। বাংলা বিভাগে স্মাতক সম্মান ও স্মাতকোত্তর কোর্স চালু হলে মুহম্মদ ফারুক (১৯৩১-৯৯) খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সৈয়দ আলী আহসান এবং মুহম্মদ ফারুক উভয়েই ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় দক্ষ ছিলেন। উভয় ভাষায় দক্ষতার কারণে ইংরেজি অর্ধবার্ষিক সম্পাদনা এবং উর্দু ভাষা অধ্যুষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান করা সম্ভব হয় তাদের পক্ষে। সৈয়দ আলী আহসান বাংলা একাডেমিতে যোগ দেওয়ার পর ১৯৬১-৭০ সাল থেকে মুহম্মদ ফারুক বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন এবং লিটারেরি রিভ্যুউ সম্পাদনা করেন। তার সময়ে উপাচার্য ছিলেন ইসতিয়াক হোসেন কোরেশী (১৯৬১-৭১)।

১৯১৭ সালের স্যাডলার কমিশনের প্রস্তাবানুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথমটি প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, দ্বিতীয়টি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। বাংলা বিভাগ-বিযুক্ত করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। তবে ভাষা আন্দোলনের পর অচিরেই সেখানে যুক্ত হয় বাংলা বিভাগ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলা বিভাগের উদ্ভব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং অত্যাবশকীয়ভাবে ভাষা আন্দোলনের পর তার বিকাশ।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, মিরপুর কলেজ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close