ড. মো. মোরশেদুল আলম

  ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

বিশ্লেষণ

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও নিরাপত্তাঝুঁকি

চীনের কৌশলগত মিত্র মিয়ানমারে দীর্ঘদিন ধরে সামরিক শাসন চলছে। সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে দেশটির সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করেছিল। ২০১৬ সালে বেসামরিক নেতা অং সান সুচি ক্ষমতায় এলে অল্প সময়ের জন্য এই ধারার পরিবর্তন ঘটেছিল। তবে ২০২১ সালে সু চিকে ক্ষমতাচ্যুত করে আবার দেশটির ক্ষমতায় আসে সামরিক বাহিনী। সুচির এই সংক্ষিপ্ত শাসনামলে দেশটির রাখাইনে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সহিংস হামলা হয়। এতে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতের ঘটনাও ঘটেছিল। এরপর থেকে দেশটির বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সহিংস সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যকার এ উত্তেজনা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি এবং আরাকান আর্মি মিলে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স গঠন করে। চলতি বছর এই জোট কয়েকটি সাফল্য দাবি করে। শত শত সামরিক পোস্ট ও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত ক্রসিং দখল করে নেয়। এ সময় সশস্ত্র সংঘর্ষে উভয় পক্ষের হাজার হাজার সেনা ও যোদ্ধা নিহত হয়েছে।

ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) দেশের বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের দাবি করছে। এনইউজি সমর্থিত পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) কমান্ডে অন্তত ৩০০ ইউনিট রয়েছে। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স ২৭ অক্টোবর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অনেক সেনাঘাঁটি ও কয়েকটি শহর দখল করে নিয়েছে। এই সমন্বিত আক্রমণে চীন, থাইল্যান্ড ও ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বাণিজ্য রুট এবং বাণিজ্য ক্রসিং পোস্টগুলোর গুরুত্বপূর্ণ বিভাগসহ কয়েকটি টাউনশিপ ইএওগুলোর দখলে এসেছে। মিয়ানমারের জাতিসংঘের বিশেষ দূতের বিবৃতি উল্লেখ করে ইরাবতি পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অভ্যুত্থানের পর বাজেটে সামরিক ব্যয় বাড়লেও গত বছরের অক্টোবরে শুরু হওয়া বিদ্রোহী গোষ্ঠীর আক্রমণের কারণে জান্তা সরকার কয়েক ডজন শহর, কয়েক শ টহল চৌকি, পুরো একটি অস্ত্রাগারের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। মিয়ানমারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে কাজ করা বিশেষজ্ঞদের একটি দল ‘স্পেশাল অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল ফর মিয়ানমার’ প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, দেশটির জান্তা সরকারের ‘পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ’ রয়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ ভূখণ্ডের ওপর, ২৩ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের দখলে রয়েছে ৫২ শতাংশের মতো ভূখণ্ড। এমন পরাজয়ের কারণে সামরিক শাসনের কট্টর সমর্থকরাও সেনাপ্রধানের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন। কারণ এসব পরাজয় সামরিক বাহিনীর জন্য লজ্জাজনক বলে মনে করছেন তারা।

যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব পিস বলছে, মিয়ানমারে বর্তমানে কর্তৃত্ববাদবিরোধী যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে, তা এখন পর্যন্ত সফল বলেই মনে হচ্ছে। দেশটিতে এর আগের গণতন্ত্রপন্থিদের তুলনায় বর্তমানে চলমান প্রতিরোধ আন্দোলন জাতীয় অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে এবং এটি বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, যারা জান্তা সরকারকে উৎখাতে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি। মিয়ানমারের চীন রাজ্যে বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরা মিলে জান্তার বিরুদ্ধে চিনল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্স (সিডিএফ) একত্রে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। সিডিএফ চীন রাজ্যের খ্রিস্টানদের নিয়ে গঠিত, তবে এতে মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠী বার্মার বৌদ্ধরাও রয়েছে। অভ্যুত্থানের পর থেকে জান্তা বৈধতার জন্য মিয়ানমারে ধর্মীয় বিভাজন কৌশলকে বেছে নিয়েছিল। জান্তাপ্রধান মিন অন হ্লাইং বৌদ্ধধর্মের রক্ষক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে বৌদ্ধধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে বিভিন্ন জাতিগত ও ধর্মীয় যোদ্ধারা নিজেদের এবং পরিবারের অংশ মনে করে এবং তাদের শত্রু এখন শুধু মিয়ানমার সামরিক বাহিনী। বিভিন্ন জাতিগত, ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক পটভূমির যুবকরা প্রতিরোধ গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছে। তারা একটি আদর্শ মিয়ানমার রাষ্ট্র চায়, যেখানে সব জাতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে সমান আচরণ, কথা বলার স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক সুযোগ থাকবে। মিয়ানমারে বহু দশক ধরে সেনাবাহিনীর প্রতি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সমর্থন সেনাবাহিনীর মনোবল বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করে আসছিল। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে বিভক্তি ও সেনাবাহিনীর প্রতি একতরফা সমর্থন হ্রাসের কারণে অনেক সাধারণ মানুষও সেনাবাহিনীর প্রতি তাদের সমর্থনের বিষয়ে মনোভাব পরিবর্তন করেছে। মিয়ানমারের ভিক্ষুরা এখন সামরিক শাসন সমর্থন করেন না। এখন বৌদ্ধ মঠগুলোতে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে এবং সেখান থেকে অনেক সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠীতে যোগ দিচ্ছেন।

সামরিক জান্তা বর্তমানে দেশের অন্যান্য সীমান্ত অঞ্চলে যুদ্ধরত ইএওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে রাখাইনে অবরোধ আরোপ করেছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জান্তার অবরোধের ফলে বাসিন্দারা ক্রমাগতভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষের চলাচলে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে এবং রাজ্যের ভেতরে ও বাইরে সব রাস্তা ও জলপথে অবরোধ আরোপ করার ফলে খাদ্য, জ্বালানি এবং অন্যান্য মৌলিক সামগ্রীর অভাবে জনগণের ভোগান্তি বাড়ছে। আরাকান আর্মি (এএ) এবং রাখাইনের জনগণ জান্তার ‘ফোর কাট স্ট্র্যাটেজি’র কারণে মানবিক সংকটে রয়েছে। ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ) বেসামরিক নাগরিকদের জন্য মানবিক সহায়তা চাইছে। ভয়েস অব আমেরিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের বিরোধী সশস্ত্র দলে জাতিগত ২০টি গোষ্ঠীর ১ লাখ ৩৫ হাজার সদস্য, ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট-এনইউজির আওতায় পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের ৬৫ হাজার সদস্য এবং সিভিল ডিসঅবিডিয়েন্ট মুভমেন্টের অধীনে প্রায় ২ লাখের মতো কর্মী রয়েছে। এনইউজির আন্তর্জাতিক সহযোগিতাবিষয়ক উপমন্ত্রী ডেভিড গাম অং এর আগে ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, ‘স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়ছে এমন কয়েকটি জাতিগত গোষ্ঠীর সঙ্গে ২০২২ সালে জোট গঠন করেছে এনইউজি। এদের প্রায় দুই লাখ সেনার একটি বাহিনী রয়েছে, যা আরো বাড়তে থাকবে। এটি জেনারেল মিন অং লাইংয়ের বাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট।’ অন্যদিকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীতে প্রায় ৪ লাখ সেনা রয়েছে বলে মনে করা হলেও যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট ফর পিসের তথ্যানুযায়ী, মিয়ানমার সামরিক বাহিনীতে প্রায় দেড় লাখের মতো সেনা রয়েছে। এর মধ্যে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত বা ‘কমব্যাট রেডি’ ৭০ হাজার সেনাও অন্তর্ভুক্ত। এরা আবার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের সঙ্গে তেমনভাবে সংশ্লিষ্ট নয়। বর্তমানে নর্দান অ্যালায়েন্স বা ফ্রেন্ডশিপ অ্যালায়েন্স চীনের আশীর্বাদপুষ্ট। এখানে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী আবার চীনের আশীর্বাদপুষ্ট। বরং এটি চীনের একটি কৌশল।

আরাকানে ভূ-রাজনৈতিক কৌশল ও ভূ-রাজনৈতিক অর্থনীতিবিষয়ক বিপুল স্বার্থ রয়েছে চীন ও ভারতের। সেটার ওপর পারস্পরিক আঘাত হানার প্রচেষ্টা থেকে এই যুদ্ধ চলছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। মিয়ানমার সীমান্তের গোলাগুলি ও হতাহতের ঘটনায় প্রয়োজনীয় সবকিছু করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ও বিজিবিকে ধৈর্য ধারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ঘটনা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রায় দুই মাস ধরে বান্দরবানের ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু, কোনারপাড়া, উত্তরপাড়া, বাইশফাঁড়ি, চাকমাপাড়াসহ উখিয়া এবং টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে দেশটির সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠীর সংঘর্ষ চলছে। এই পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের দিক থেকে ছোড়া মর্টার শেলসহ বিভিন্ন গোলাবারুদ কয়েকবার বাংলাদেশে এসে পড়ে। মিয়ানমারের জেট ফাইটার হেলিকপ্টারও কয়েকবার আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে। সীমান্তের ওপার থেকে আসা মর্টার শেলের আঘাতে কয়েকজন হতাহতও হয়েছে। সীমান্তে গোলাগুলির এসব ঘটনায় ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে কয়েকবার তলব করে প্রতিবাদ জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মিয়ানমারে স্বাধীনতাকামী আরাকান আর্মির সঙ্গে চলমান সংঘাত ও সংঘর্ষের ঘটনায় দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) প্রায় ২০০ সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। ইতিমধ্যে মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলিতে দুজন নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনার কারণে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

মিয়ানমারের চলমান উত্তেজনা ও অস্থিতিশীলতা প্রতিবেশীসহ আঞ্চলিক হুমকি সৃষ্টি করলেও এখনো কোনো ধরনের সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসেনি। চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ইস্যুতে আলাপ হয়েছে মন্তব্য করে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, চীনের সঙ্গে আমাদের এখন একটা তো চলমান ইস্যু রয়েছে, রোহিঙ্গাদের বিষয়। এ বিষয়ে চীন একটা ভূমিকা নিতে পারে। এখানে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা হয়ে গেছে ১৩ লাখের মতো। এটা আমাদের জন্য অতিরিক্ত বোঝা। এমনিতে বিশ্ব সংকটের কারণে আমরাও সংকটে আছি। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত, এখন যেটা আরাকান আর্মি এটার রেশ আমাদের সীমান্ত এলাকা পর্যায়ে গেছে। আমাদের সীমান্ত থেকেও গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যায়। একটা আতঙ্ক তো আছে। আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ না, যুদ্ধ তাদের অভ্যন্তরীণ। কিন্তু আমাদের সীমান্তে এসে যখন এ যুদ্ধের গোলাগুলির আওয়াজ, তখন স্বাভাবিক কারণে একটা ভয়ভীতি আমাদের নাগরিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। এ বিষয়টিতে চীনের হস্তক্ষেপ আশা করছি।

লেখক : শিক্ষক ও কলাম লেখক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close