তানজিব রহমান

  ২৩ অক্টোবর, ২০২৩

দৃষ্টিপাত

পিটার হাস অবতার হলে মরিয়ার্টি কী

বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার মতপার্থক্য নিরসনে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান দলের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রাক-নির্বাচন মূল্যায়ন প্রতিনিধিদল সফর করে গেল। তারা কেউই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি কোনো প্রতিনিধিদল নয় বরং রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট সমর্থনপুষ্ট গবেষণা সংস্থা বা এনজিও বলা যেতে পারে। বেসরকারি সংগঠন আইআরআই (ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট) ও এনডিআই (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের) প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলটি প্রায় এক সপ্তাহ ঢাকা সফর শেষে কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে ও পাঁচটি বিষয় সুপারিশ করে।

সুপারিশগুলো হলো একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে অর্থবহ সংলাপ, রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা, বাকস্বাধীনতার সুরক্ষা ও ভিন্নমতকে সম্মান করা হয় নাগরিকদের জন্য এমন পরিবেশ তৈরি করা, স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনাসহ এমন পরিবেশ তৈরি করা যাতে সব দল একটি অর্থবহ নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় শামিল হতে পারে এবং নাগরিকদের মধ্যে সক্রিয় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনে অংশগ্রহণের সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করা। আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে আলোচনা শেষে বলেছে, অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু বিএনপি বরাবরের মতো সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বলেছে এবং শর্তযুক্ত সংলাপ চায়। অর্থাৎ সমাধান বা ফলপ্রসূ তেমন কিছুই হয়েছে বলে মনে হয়নি। কারণ অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আমাদের সবার চাওয়া। সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ সে পথে হাঁটছেও কিন্তু নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা থাকলেও তাতে যদি রজনৈতিক অংশীজনরা সহযোগিতা না করে তা কীভাবে সুফল আনবে?

বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানে বিদেশিদের পরামর্শ নতুন কিছু নয়। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ তার পশ্চিমা মিত্ররা দখলদার ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে কথা বলছে, সেখানে বাংলাদেশেও তারা নিজেদের স্বার্থের বাইরে কিছু বলবে না। পশ্চিমারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নাগরিকদের ভয়-ভীতি ছাড়া নিজেদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বললেও ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানিতে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে রাস্তায় প্রকাশ্যে মিছিলের ব্যাপারে দেশগুলো কঠোর নিষেজ্ঞা আরোপ করেছে। এ ছাড়া গাজার হাসপাতালেও যেভাবে রকেট হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যা করছে মার্কিন মিত্র দখলদার ইসরায়েলী বাহিনী, তা সামনের দিনে আরো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, যা সমাধানেও পশ্চিমাদের পক্ষপাতমূলক নীতি বিশ্বকে হতবাক করছে।

আমাদের নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মাঠের রাজনীতির বাইরেও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে বিদেশি তৎপরতা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে তৎপরতা যখন বারবার সমালোচনার আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তখন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে ‘ভগবান’ ‘অবতার’ আখ্যা দেওয়ার বিষয়টি আরো তুমুল সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সম্প্রতি ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দেশীয়-আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনারে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বলেন, ‘মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি আমাদের জন্য অবতার হয়ে এসেছেন। তার তো আমাদের আরো সাহস দেওয়া দরকার, বাবারে তুই আমাদের বাঁচা, রক্ষা করো। তারে বলতে হবে- আমি আছি তোমাদের সঙ্গে, তোমরাও ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি, আমরাও ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি। পিটার হাস- বাবা ভগবান আসসালামু আলাইকুম’।

একজন মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে অবতার হিসেবে বক্তব্য দেওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে সর্বত্রই বিএনপি নেতা শাহজাহান ওমর সমালোচিত হয়েছেন, হচ্ছেন। বাংলাদেশের অন্যতম এ রাজনৈতিক দলটি জনগণের শক্তির ওপর কেন তাদের আস্থা হারিয়ে বিদেশি দূতদের কাঁধে ভর করেছে- প্রশ্ন সবার মনে। তাই প্রশ্ন করা যেতেই পারে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস যদি বিএনপির জন্য অবতার হন তবে ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি তাহলে কী? শাহজাহান ওমর কিংবা বিএনপি নেতারা এ প্রশ্নের জবাবে কী বলবেন? সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি তো বিএনপি নেতা তারেক রহমানকে ‘ভয়ংকর রাজনীতিক ও গণতন্ত্রের জন্য হুমকি’ যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর বলে আখ্যায়িত করে যুক্তরাষ্ট্রে তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন, যা পরে উইকিলিংকসের গোপন নথিতে প্রকাশ পায়। তার মানে কি অবতাররা বারবার আগমন করেন ভিন্ন রূপে! জেমস এফ মরিয়ার্টির গোপন তারবার্তার কারণেই বাংলাদেশের প্রথম কোনো রাজনীতিক হিসেবে তারেক রহমান এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারেননি। বিএনপি নেতারা যাদের আশীর্বাদপুষ্ট ভগবান বলছেন তাদের আশীর্বাদেই তো তারেক রহমান প্রথম ভিসা স্যাংশনের শিকার হলেন।

অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উল্লেখ করেন, ‘২০১৪ সালে যা করতে পেরেছেন, ২০১৮ সালে যেটা করতে পেরেছেন এবার ২০২৩ সালে সেই নির্বাচন আপনি করতে পারবেন না। কারণ এবার মানুষ যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে- তাতে করে সেটা সম্ভব হবে না’। বাস্তবতা হচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী ৭১-এর রাজাকারদের বিচার হওয়ার ফলে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি তাদের জোট জামায়াতের প্রতি তাদের যে ভালোবাসার প্রতিদান দিতে গিয়ে নির্বাচনের ট্রেনে উঠতে চরম ভুল করে। ফলে রাজনৈতিক কৌশলে তারা সত্যের কাছে পরাজিত হয়। আর অবতাররাও বিএনপি-জামায়াত জোটের ভুলের খেসারত দিতে মায়াকান্না দেখায়নি, ফলে তারা অগ্নিসন্ত্রাসকে ভুলের প্রতিশোধ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ২০১৮-এর নির্বাচনে তো ছিল মনোনয়নের রমরমা বাণিজ্য, যা বিএনপির রাজনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। তাদের আন্তকোন্দল, সঠিক নেতৃত্বের অভাব, তিনশো আসনে সাতশোর অধিক মনোনয়ন বিক্রি বিএনপিকে গণমুখী রাজনীতি থেকে ছিটকে দেয়। তার সুযোগ খুব ভালোভাবে ঘরে তুলে নেয় স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী গণমানুষের দল আওয়ামী লীগ। বিএনপির দেশি-বিদেশি অনেক অবতার তখনো দেশবিরোধী নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের গণভিত্তির কাছে টিকতে পারেনি।

ব্রিটিশ শাসন থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসন বাংলাদেশের গণতন্ত্র উদ্ধারে বিদেশিরা নয় বাংলার দামাল ছেলেরাই লড়াই-সংগ্রাম করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিল ৩০ লাখের অধিক বাঙালি কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতা। শহীদদের চেয়েও যারা আজকে বিএনপি নেতাদের কাছে ক্ষমতা লাভের অবতার কিংবা শক্তিশালী ভগবান হয়ে উঠছেন, সেই বিদেশি দূতরা কীভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অবতার হন? যারা এ কথা বলছেন তারা ক্ষুদীরাম, সূর্যসেন, প্রীতিলতা কিংবা একাত্তরের শহীদদের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যর্থ হয়েছেন শহীদদের রক্তের ঋণ শোধ করতে।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close