নিতাই চন্দ্র রায়
৩০ নভেম্বর, ২০২০
বিশ্লেষণ
বোরো মৌসুমই বড় ভরসা

------
পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, ২০১০ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ভাত খাওয়ার পরিমাণ ছিল ৪৭৯ গ্রাম। ২০১৭ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৩৮৬ গ্রামে। শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষ দ্বিগুণ ভাত খায়। গত ১০ বছরে বাংলাদেশের মানুষের ভাত খাওয়ার পরিমাণ কমে আসছিল। বাড়ছিল অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের পরিমাণ। দেখা গেছে, মাথাপিছু আয়, শিক্ষার হার ও স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ও সবজিসহ নানা পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ বেড়ে যায় এবং ভাত গ্রহণের পরিমাণ কমে যায়। কিন্তু করোনা মহামারিকালে তার উল্টো ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) পক্ষ থেকে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার ওপর করোনার প্রভাব বিষয়ে পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্য খাদ্যের চেয়ে ভাতের দাম কম হওয়ায় এবং আয় কমে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের মানুষ ভাত খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। ভাত খাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধির অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় গরিব মানুষের সহায়তা হিসেবে চাল দেওয়া বাড়িয়ে দিয়েছে। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকেও করোনার কারণে আর্থিক সমস্যায় থাকা মানুষের সহায়তা হিসেবে চাল দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে বাজার থেকে চাল কেনা বেড়ে গেছে এবং বেড়ে গেছে পরিভোগের পরিমাণও।
সারা দেশে রোপণকৃত আমন ধানের শতকরা ৫০ ভাগও কাটা হয়নি। বর্তমানে প্রতি মণ আমন ধান বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা দরে। আর বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ব্রিধান ২৮ ও ব্রিধান ২৯ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে। এ কারণে এ বছর বোরো ধান আবাদে কৃষকের মধ্যে প্রবল আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। এখন সারা দেশে চলছে বোরো ধানের বীজতলা তৈরির মহোৎসব। কৃষক বিভিন্ন বেসরকারি বীজ কোম্পানির হাইব্রিড জাতের ধানবীজ ক্রয় করছেন প্রচুর, যা গত বছর দেখা যায়নি। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন কর্তৃক বাজারজাতকৃত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল বিভিন্ন ইনব্রিড জাতের বোরো ধানের বীজ ক্রয়েও কৃষকদের মধ্যে প্রচুর উৎসাহ-উদ্দীপনা দৃশ্যমান হচ্ছে।
সঠিক সময়ে সঠিক বয়সের চারা রোপণ, সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ, সেচ প্রদান এবং সময়মতো আগাছা, পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনের ওপর বোরো ধানের ফলন বহুলাংশে নির্ভর করে। দেখা গেছে, দেশের অধিকাংশ গভীর নলর্কপের মালিকরা বেশি লাভের আশায় বিলম্বে সেচযন্ত্র চালু করেন। ফলে কৃষক বোরো মৌসুমে ৩০ থেকে ৩৫ দিন বয়সের চারা মূল জমিতে রোপণ করতে পারেন না। এতে ধানের ফলন ব্যাপকভাবে কমে যায়। এ ব্যাপারে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা এবং উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের সময়মতো গভীর নলকূপগুলো চালু এবং নির্দিষ্ট বয়সের ধানের চারা রোপণে নলকূপ মালিক এবং বোরো ধানচাষিদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আউশ ও আমন ধানের তুলনায় বোরো ধানের উৎপাদন খরচ বেশি। সেচ, সার ও বালাইনাশক ক্রয়ে কৃষককে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। এজন্য বোরো ধানচাষিরা যাতে সময়মতো স্বল্প সুদে কৃষিঋণ পান; সে ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং দেশের সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে সময়মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এ বছর আমন মৌসুমে যে ছয় লাখ টন চাল কম উৎপাদিত হবে, বোরো মৌসুমে ফলন বৃদ্ধির মাধ্যমে তা অবশ্যই আমাদের পূরণ করতে হবে। বোরো মৌসুমে যেখানে ২ কোটি ১০ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়; সেখানে ২ কোটি ১৬ লাখ টন চাল উৎপাদন করা খুব কঠিন কাজ নয়। এজন্য আমাদের হাইব্রিড ও উচ্চফলনশীল ইনব্রিড জাতের গুণগত মানের বীজের ব্যবহার বাড়াতে হবে। বিশুদ্ধ বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে ধানের ফলন শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ বাড়ানো যায়। দেশে বোরো মৌসুমে ১৯.৬৭ শতাংশ জমিতে হাইব্রিড ও ৭৯.৬৬ শতাংশ জমিতে উচ্চফলনশীল ইনব্রিড জাতের চাষ হয়। হাইব্রিড জাতের গড় ফলন যেখানে ৪.৮১ টন, ইনব্রিড জাতের ফলন ৪.০১ টন। তাই হাইব্রিড বীজের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমেও বোরো মৌসুমে চালের উৎপাদন বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। হাইব্রিড ধান চাষের মাধ্যম্যে চীন ইতোমধ্যে হেক্টরপ্রতি চালের উৎপাদন ৬.৫ টনে বাড়াতে সক্ষম হয়েছে, যা এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানির প্রতি কেজি হাইব্রিড ধানবীজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৩৬০ টাকা দামে। এত বেশি দামে হাইব্রিড বীজ কেনার সামর্থ্য অনেক কৃষকের নেই। ফলে ইচ্ছে থাকলেও বহু কৃষক অর্থের অভাবে হাইব্রিড জাতের ধানবীজ ক্রয় করতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে সরকার হাইব্রিড ধান চাষের ওপর কৃষকদের প্রণোদনা প্রদান করতে পারে। সরকার সেচের ওপর যে ভর্তুকি প্রদান করে, তা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের কোনো কাজে লাগে না। এই ভর্তুকির সব সুবিধা ভোগ করেন একশ্রেণির গভীর নলকূপের মালিক। তাই সেচ ভর্তুকির অর্থ সেচযন্ত্রের মালিকদের পরিবর্তে ধান উৎপাদনকারী কৃষকদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সরাসরি দেওয়া উচিত। এতে ধানের উৎপাদন খরচ কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে এবং প্রকৃত ধান উৎপাদনকারী কৃষক লাভবান হবেন।
লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)
নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড
[email protected]
"