reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৬ মে, ২০২৪

১২৫তম নজরুল জন্মজয়ন্তী

নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ভাবনায় কবি নজরুল

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সাম্য, সম্প্রীতি, দ্রোহ, প্রেম ও গণমানুষের কবি। শৈশবে লড়েছেন দারিদ্র্যতার সঙ্গে আর যৌবনে সংগ্রাম করেছেন শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে। নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েও বঞ্চিত মানুষের পক্ষে চালিয়েছেন লেখনী। কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে থেকেছেন আপসহীন। সংগীতে সৃষ্টি করেছেন স্বতন্ত্র ধারা। কবিকে স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে এনে দেওয়া হয় জাতীয় কবির মর্যাদা। কবির কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত ময়মনসিংহ ত্রিশালে ২০০৬ সালে গড়ে ওঠে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মজয়ন্তী ও বাংলাদেশে আগমনের ৫২ বছরে কবিকে নিয়ে কী ভাবছেন নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা তা তুলে ধরছেন অনিরুদ্ধ সাজ্জাদ

বাঙালির মুক্তির প্রবক্তা নজরুল

বাঙালির সর্বমানবিক মুক্তির প্রবক্তা ও বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সর্বসাধারণের কবি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দে জন্ম নেওয়া এই কবি বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক এবং দেশপ্রেমিক ছিলেন। নজরুলের চিন্তাচেতনায় বাঙালি জাতি তথা পরাধীন ভারতবর্ষকে স্বাধীনতাকামী করতে অনুপ্রাণিত করেছে। অবহেলিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত বাঙালি তার দ্রোহের অনির্বাণ শিখায় জ্বলে উঠেছে বজ্রশপথে। অনাচার ও অত্যাচার এর প্রতিরোধে উৎপীড়িতের চিরদিনের প্রেরণা তিনি। বাংলা সাহিত্যে নজরুলই প্রথম, যিনি গণমানুষের পক্ষে এবং শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে লেখার জন্য কারাবরণ করেছেন। তার গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হয়েছে, পত্রিকা বন্ধ করা হয়েছে, প্রতিবাদী কণ্ঠ পৌঁছেছিল পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামী মানুষের চিত্তে। কবির চেতনা ও আদর্শ চিরভাস্বর হয়ে আছে আমাদের জীবনে। ১৯৭২ সালে ২৪ মে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কবিকে নাগরিত্ব প্রদান করেন। একই বছর ২১ ফেব্রুয়ারি কবিকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। নজরুলের জন্মজয়ন্তী উদযাপনে বরাবরের মতো এবারও মনোজ্ঞ আয়োজন করে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। এ বছর নজরুলজয়ন্তী শুধু ত্রিশালের নামাপাড়ায় সীমাবদ্ধ নয়, প্রথমবারের মতো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উদযাপিত হয়। এভাবেই বাংলাদেশের জাতীয় কবি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকুক সবার হৃদয়ে।

ইয়াসমিন আক্তার স্মৃতি

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়

ভাবনায় কবি নজরুল

বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যিনি প্রেম-দ্রোহ-মানবতা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন ধূমকেতুর মতো। আমৃত্যু গেয়েছেন মানবতার জয়গান, লিখেছেন ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’

কবি নজরুল শুধু কবিই নয়, ছিলেন অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এক বীরযোদ্ধা। তিনি কবিতা আর গানে জাগিয়ে গেছেন বিদ্রোহ। তাই তো তাকে বলা হয় বিদ্রোহী কবি। দ্রোহের পাশাপাশি তিনি শুনিয়েছেন প্রেম-বিরহের কবিতা, গানও। শৈশব থেকে দুঃখ-দারিদ্র্যের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে বেড়ে ওঠা এই দুখু মিয়া মাত্র ১২ বছর বয়সে যোগ দিয়েছিল লেটোর দলে। দারিদ্র্য ঘুচাতে ১৯১২ সালে আসানসোলে কারিগর হয়েছিলেন চা-রুটির দোকানে, পরিচিত হয়ে উঠেছেন কবি, দার্শনিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, সৈনিক, সাংবাদিক, অভিনেতা প্রভৃতি হিসেবে। তিনি কলম ধরেছিলেন শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে। তার লেখনী ছিল শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে। যার ফলে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল তার বিষের বাঁশি, ভাঙার গান, প্রলয় শিখা, চন্দ্রবিন্দু ও যুগবাণী গ্রন্থগুলো। হয়েছেন কারাবন্দিও। নজরুল মানেই সাম্যবাদী মনোভাবের এক নক্ষত্র। সাম্যের জন্য লড়ে যাওয়া এক অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক, যার কলমের কালি ইংরেজদের বুকে ছুড়েছে বিষাক্ত তীর। আপন ভঙ্গিতে, আপন খেয়ালে, স্বকীয়তায় সাহসীকতার এমন লেখনী বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ। দুরন্ত, সাহসী, মুক্ত খেয়ালিপনার এই মহামানবের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

শাহরিয়ার সুমিত ইমরান

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়

অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি নজরুল

ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠে মানবমঙ্গলের গান গেয়ে, নিপীড়িত মেহনতি মানুষের প্রগতি চেয়েছেন যিনি, তিনিই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি অত্যাচারীতের প্রতিনিধি, সাম্যের বাহক, বৈষম্যে বিদ্রোহী, গেয়েছেন মানুষের জয়গান আর প্রাণে ছিল তারুণ্যের জয়োল্লাস। সম্প্রীতি বিনির্মাণে নজরুল গেয়েছেন হিন্দু-মুসলিম মিলনের গান। লিখেছেন উভয় ধর্মের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর বীর পুরুষদের বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনি। কবি যেমন ইসলামি ভাবধারার গান লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন শ্যামা সংগীত। অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করা এবং সব সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দূর করার প্রচেষ্টা তার জীবনে অব্যাহত ছিল। তিনি মানুষে-মানুষে যে বিবাদ, যে প্রতিহিংসা চলে আসছে তার বিরুদ্ধে লিখে গেছেন। মানুষ, মনুষ্যত্ব, মানবতা, সাম্য, একতা এসব মানবিক উপাদান কবি নজরুলের কবিতায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে আর তারুণ্যের বুকে প্রেরণা জুগিয়েছে। আর তাই কবির ১২৫তম জন্মজয়ন্তীতেও কবি হয়ে ওঠে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক। নজরুল কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণি-গোত্রের কবি নন, নজরুল গণমানুষের কবি। সমাজে নজরুলের দর্শন ও চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। সমাজকে রাখতে হবে সব সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে। কবি নিজেকে এর ঊর্ধ্বে রাখতে পেরেছেন বলেই লিখে গেছেন- ‘গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা

ব্যবধান।’

মো. সাইফুল ইসলাম

শিক্ষার্থী, মার্কেটিং বিভাগ, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়

জাতীয় কবির স্বীকৃতিতে প্রজ্ঞাপন জারি হোক

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি জাতীয়তাবাদের কবি। অসাম্প্রদায়িক, সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের যুগ প্রবর্তক কবি, স্বাধিকার আন্দোলন ও সংগ্রামী চেতনার কবি। সাম্যবাদী চেতনার অন্যতম আদর্শ কবি কাজী নজরুল ইসলাম কুলি-মজুর কবিতায় বলেছেন- ‘সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি/এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।’

মানুষ ও সমাজের মূল্যবোধ পরিবর্তনে কবির প্রচেষ্টা ছিল চির দুর্বার। সমাজের সর্বস্তরের অসাম্য প্রতিরোধ করতে কবির লেখনী হয়ে উঠেছিল হিমালয়ের মতো অনড়। তার রচনায় স্থান পেয়েছে অস্তিত্ববাদী ও মানবতাবাদী চিন্তার নিঃশঙ্কোচ প্রকাশ; দরিদ্র-অশিক্ষিত ক্ষুধার্ত-অত্যাচারিত জনতার জন্য শ্রম আর সৌন্দর্য উপভোগের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় সাজিয়েছেন কবির কথামালায়। নজরুলের সৃষ্টিশীল কর্মজীবনের মূলমন্ত্র ছিল জাতি-ধর্ম-গোত্রের বিভেদমোচন। অথচ জাতীয় পর্যায়ে ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন আয়োজনে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি লেখা হলেও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, জাতীয় আর্কাইভ, নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির কোথাও নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা করা-সংক্রান্ত কোনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি বা দলিল পাওয়া যায়নি। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সংসদে আইন পাস করে এই স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।

তবে সরকারি দলিলে বিভিন্ন প্রসঙ্গে নজরুলকে জাতীয় কবি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাকে জাতীয় কবি উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় (জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ) ও বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ প্রণীত হয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতের স্বীকৃতি সংরক্ষণের বিষয়টি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আজকের বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যে চেতনা তার নাম মানবতা। ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই, নহে কিছু মহীয়ান’ আজ যেন আমাদের প্রাত্যাহিক উচ্চারণের মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাইসা ইসলাম জীম

শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close