শামীম হোসেন সামন, দোহার-নবাবগঞ্জ (ঢাকা)

  ১৮ অক্টোবর, ২০২৪

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য

গ্রামবাংলার ‘বৈঠকি গান’ হারিয়ে যাচ্ছে

গ্রামবাংলার বৈঠকি গান হারিয়ে যাচ্ছে

একসময় শীতের মৌসুমজুড়ে গ্রামের প্রায় বাড়িতেই বৈঠকি গানের আয়োজন করা হতো। সন্ধ্যা হলেই আমুদে গ্রামবাসীরা দলে দলে যোগ দিতেন সেই গানের আসরে। কেউ তবলা হাতে আবার কেউ ঢোল। কেউবা বাঁশি আবার কেউ কেউ সঙ্গে নিয়ে আসতেন হারমোনিয়াম। এভাবেই দলবেঁধে বাদ্যযন্ত্রকে সঙ্গে নিয়ে ছুটতেন কাঙ্ক্ষিত সেই গানের আসরে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গানের আসরও যেন পূর্ণতা পেত গ্রামের নানান বয়সি মানুষ সেখানে ভিড় জমাতেন। ছোটরা দু-এক ঘণ্টা গান শুনে বাড়ি ফিরলেও বয়স্করা ফিরতেন ভোরে। কোনো কোনো দিন রাত পেরিয়ে সকাল হলে বাড়ি ফিরতেন। একসময় এমনই দৃশ্য চোখে পড়ত গ্রাম-গঞ্জে।

কালের বিবর্তনে সে চিরচেনা সংগীত দেখা মিলে না আর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়ায় গেছে সে দৃশ্য। গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ বৈঠকি গান। এই গানকে লালন ও ধারণ করে একসময় অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। সারা দেশের মতো ঢাকার দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলায় বেশ কদর ছিল বৈঠকি গানের। সম্প্রতি ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার বারুয়াখালী ইউনিয়নের দীর্ঘগ্রাম এলাকায় ওরস উপলক্ষে এ গানের আয়োজন করা হয়। সেখানে অংশ নেওয়া গায়করা এ গানের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার দাবি জানান।

ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার বারুয়াখালী ইউনিয়নের দীর্ঘগ্রাম এলাকার নুরুল ইসলাম। ১৫ বছর ধরে বিভিন্ন এলাকায় বৈঠকি গান করেন তিনি। গান গেয়ে সংসার চালানো অসম্ভব বলে নিজ এলাকায় দিয়েছেন মুদি দোকান। তবু গানকে জীবনের একটি অংশে রেখেছেন। দিনে মুদি দোকানি হলেও সন্ধ্যায় কোথাও গানের আয়োজন হলে সে গানের আসরে বসেন তিনি।

বৈঠকি গান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যার পরপর আমরা গানের আসরে যাইতাম। সে সময় অনেক বাড়িতেই বৈঠকি গানের আয়োজন ছিল। আমরা আনন্দ নিয়ে গান গাইতাম। এখন তো আর গানের আয়োজন হয় না এখন গানকে ধরে রাখতে একা একাই বাড়িতে কিংবা দোকানে বসেই গান গাই।’

বারুয়াখালী ইউনিয়নের ভাঙ্গাপাড়া গ্রামের মো. হারুন। বাপ-দাদার আমল থেকেই বৈঠকি গান শুনতেন। এরপর ধীরে ধীরে গানের প্রতি আগ্রহ থেকেই বৈঠকি গান শিখেছেন। এখন নিজেই বিভিন্ন এলাকার আসরে গান করে থাকেন। সময়ের সঙ্গে গানের আয়োজন কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া তার মতে এ গান সম্পর্কে আগামী প্রজন্মে জানবেই না। তবে ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে পারলে আগামী প্রজন্মও গান সম্পর্কে জানতে পারবে। তিনি আরো বলেন, ‘ছোটবেলায় দেখতাম আমাদের গ্রামে অনেক বাড়িতে গানের আয়োজন হতো। শীত আসলেই গানের মৌসুম শুরু হয়ে যেত। এখন আর আগের মতো আয়োজন হয় না, তাই মনে আনন্দ থাকে না।’

দোহার উপজেলার বৌবাজার এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম। অন্ধ হলেও ছোটবেলা থেকে গানবাজনার সঙ্গে জড়িত। একসময় সারা বছর গানের আয়োজন কম থাকলেও শীতের মৌসুম এলে গানের আসর জমত। এখন শীত আসলেও আগের মতো গান হয় না। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। তিনি আরো বলেন, ‘শখের বিষয়ে গান শিখেছি। একসময় খুবই ভালো চলছিল। এখন দিন দিন গানবাজনা আর হয় না। সংসারের খরচ জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমরা এখন ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে লড়াই করছি।’

ভাঙ্গাপাড়া গ্রামের সোহেল মিয়া নামের এক গায়ক বলেন, ‘গান শুনতে গিয়ে ঢোল বাজানো শিখেছি। গানের আয়োজন কম থাকায় দিন দিন ঢোল বাজানোও ভুলে যাচ্ছি।’ জৈনতপুর এলাকার মতিউর রহমান নামের এক গায়ক বলেন, ‘১৮ বছর ধরে গান গাই। এখন মানুষ আধুনিক হয়ে গেছে। এখন শীত আসলেও গানের আয়োজন থাকে না। শীত আসলে আগেরকার দিনের কথাগুলো মনে পড়লে অনেক খারাপ লাগে।’ একই এলাকার রাজিব হোসেন নামে এক গায়ক জানান, ‘বাদ্যযন্ত্র মেরামত করতে যে খরচ হয় গান গেয়ে সে খরচও ওঠে না। মানুষ এখন গানে সন্তুষ্ট হয় না। আমরাও এখন এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে এসেছি।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close