প্রণব দাস, যশোর প্রতিনিধি
ধনপোতা ঢিবির খনন ফের শুরু
পাল্টে যাচ্ছে প্রচলিত ধারণা
নদীমাতৃক বাংলাদেশের যশোর অঞ্চলের নবীন ভূমি গঠনের কারণে ধারণা করা হত সেখানে প্রাচীন কোনো নিদর্শন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু যশোরের ‘ধনপোতা ঢিবি’র আবারো খননকাজে আগেকার এসব ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। এর আগেও ‘ধনপোতা ঢিবি’র প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ শুরু হয়েছিল।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নব্বই দশকের পূর্ব পর্যন্ত এ অঞ্চলের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে সংশয় ছিল। ঐতিহাসিকদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, ভূমি গঠন নবীন হওয়ায় এ অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু মণিরামপুরের ধনপোতা ঢিবি, দমদম পীরস্থান ঢিবি, ডালিঝাড়া প্রত্নস্থল খননের পর সেখানে যে প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার হয়েছে, এতে ঐতিহাসিকদের প্রচলিত ধারণাকে ভুল প্রমাণ করছে। এ কারণে প্রত্নস্থল সম্পর্কে আরো জানার অভিপ্রায়ে যশোর জেলার মণিরামপুর উপজেলার খেদাপাড়া গ্রামের ধনপোতা ঢিবিতে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যক্রম ফের শুরু হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন।
গত মঙ্গলবার প্রধান অতিথি হিসেবে খনন কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন মণিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত তামান্না। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ এলাকার লোকজন অংশগ্রহণ করেন।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে এ প্রত্ন ঢিবিটি ২০০৭ সালে চিহ্নিত করা হয়। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছর থেকে প্রথম প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধান ও দিকনির্দেশনায় এ প্রত্ন ঢিবিতে খনন কার্যক্রম শুরু হয়। বিগত অর্থবছরে ১১টি বর্গে হ্যারিস ম্যাট্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ উন্মোচনসহ খননে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুসমূহ নথিভুক্তকরণ করা হয়। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রত্ন ঢিবির সীমিত একটি অংশে খনন পরিচালনা করে প্রাচীন ইট নির্মিত চতুষ্কোণ প্রার্থনা কক্ষ সমেত একটি বর্গাকার স্থাপনার সন্ধান পাওয়া যায়। উন্মোচিত স্থাপনাটিকে প্রাথমিকভাবে আদি মধ্যযুগের কোনো স্থাপত্য নিদর্শনের বলে ধারণা করা হয়। কোনো প্রামাণ্য ঐতিহাসিক উপাদান (শিলালিপি, মুদ্রা বা স্মারক নিদর্শন) পাওয়া না যাওয়ায় স্থাপত্য কাঠামোর ব্যবহারিক উদ্দেশ, প্রকৃতি এবং ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
যশোর জেলার মণিরামপুর উপজেলার খেদাপাড়া গ্রামে চারদিকে ধূ-ধূ মাঠ। মাঠের মাঝখানে সুউচ্চ একটি ঢিবি। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে এটি পরিচিত ধনপোতা ঢিবি/ বিরাট রাজার ঢিবি/ধনপতি সওদাগরের বাড়ি নামেও পরিচিত। প্রাচীন এ ঢিবিকে কেন্দ্র করে শত শত বছর ধরে এ অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে নানান জনশ্রুতি। জনশ্রুতির কাহিনির সঙ্গে মহাভারতের পৌরাণিক কাহিনির মধ্যেও মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মহাভারতের ‘বিরাট পর্বে’ উল্লেখ আছে, পঞ্চপা-ব বনবাস থেকে বিরাট রাজার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। খেদাপাড়ার ধনপোতা ঢিবিকে কেউ কেউ মহাভারতের সেই বিরাট রাজার ধ্বংসাবশেষ বলেও মনে করেন।
অনেকে মনে করেন, বিপুল পরিমাণ গুপ্তধন পুঁতে রাখা আছে বলেই ঢিবির নামকরণ করা হয়েছে ধনপোতা ঢিবি। ‘মহাভারত’-এর বিরাট পর্বে শকুনি মামার চক্রান্তে পাশা খেলায় হেরে যাওয়ার শর্তানুযায়ী পঞ্চপা-বকে ১২ বছর অজ্ঞাতবাস দেওয়া হয়। অজ্ঞাতবাস শেষে পঞ্চপা-ব যে স্থানে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই স্থানের সঙ্গে এ ঢিবির অনেকটাই মিল খুঁজছেন অনেকে।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও প্রত্ন সূত্রের ভিত্তিতে যশোরের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে প্রথম ধারণা দেন বরেণ্য প্রত্নতত্ত্ববিদ এন দীক্ষিত। বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে তিনি যশোরের ভরত ভায়না/ জটার দেউল বা ভরত রাজার দেউল পরীক্ষামূলক খনন করে ঢিবির নিচে বিলুপ্ত প্রাচীন স্থাপনার অস্তিত্বের কথা জানান। কে এন দীক্ষিতের এ প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার যশোরের প্রাচীনত্ব ঐতিহাসিকদের দীর্ঘদিনের প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা পরিবর্তনে সাহায্য করে। এরপর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে যশোর জেলার মণিরামপুর উপজেলার দমদম পীরস্থান ঢিবি, কেশবপুর উপজেলার গৌরিঘোনা ইউনিয়নের কাশিমপুর গ্রামে ডালিঝাড়া প্রত্ন স্থানে খননে প্রাগৌতিহাসিক যুগের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব প্রত্নতাত্ত্বিক ঢিবিতে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রত্নতাত্ত্বিক খননে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ন সাক্ষ্য আবিষ্কৃত হওয়ায় সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে।
"