আল-আমিন মিয়া, নরসিংদী

  ২৪ মে, ২০২৪

স্মরণ

স্মৃতিবিজড়িত পৈতৃক বাড়িটিও বেদখল

আজ মার্কসবাদী বিপ্লবী ও প্রগতিশীল সাহিত্যিক সোমেন চন্দের জন্মদিন * ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ তিনি

আজ ২৪ মে মার্কসবাদী বিপ্লবী ও শক্তিমান সাহিত্যিক সোমেন চন্দের জন্মদিন। জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে কেউ স্মরণ করে না এই মহান ব্যক্তিকে। নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল পৌর এলাকার বালিয়া গ্রামের সোমেন চন্দের স্মৃতিবিজরিত পৈতৃক বাড়িটিও বেদখলের কারণে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এলাকাবাসী মহান এই নেতার পৈতৃক বাড়ি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন।

মাত্র ২২ বছরের জীবনে সোমেন চন্দ সাহিত্যে যা সৃষ্টি করেছেন, তা অসামান্য। বাংলা ভাষায় প্রথম দাঙ্গার গল্প লেখায় পথিকৃৎ তিনি। ১৯২০ সালের ২৪ মে ঢাকার কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যার তেঘরিয়া গ্রামে মাতুতালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৬ সালে পোগোজ স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষার উত্তীর্ণ হন। ঢাকা মিটফোর্ড মেডিকেল ভর্তি হলেও পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেননি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোমেন চন্দের স্মৃতি ধারণ করে নিজের পৈতৃক জমিতে ‘সোমেন চন্দ পাঠাগার’ নামে একটি পাঠাগার গড়ে তুলেছেন শহিদুল হক সুমন নামে এক ভক্ত। তিনি প্রতি বছর সোমেন চন্দের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নিজ উদ্যোগে স্মরণসভার আয়োজন করেন।

সোমেন চন্দের পৈতৃক বাড়ি নরসিংদীর পলাশ উপজেলার বর্তমান ঘোড়াশাল পৌর এলাকার বালিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম নরেন্দ্র কুমার ও মা হীরণ বালা। ১৯৩৭ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশ হয় তার প্রথম গল্প ‘শিশু তপন’। ওই বয়সেই বাংলাদেশে বন্যার যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ভোগ, তা নিয়ে সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে প্রথম উপন্যাস ‘বন্যা’ লেখেন সোমেন। তিনি প্রগতি লেখক সংঘে যোগদান করেন এবং মার্কসবাদী রাজনীতি ও সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনিই বাংলা সাহিত্যে প্রথম গণসাহিত্যের ওপর কাজ করেন। ১৯৪১ সালে সোমেন প্রগতি লেখক সংঘের সম্পাদক নির্বাচিত হন। মেধাবী সোমেন চন্দেও লেখা সাধারণত প্রগতি লেখক সংঘের সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক সভাগুলোয় পাঠ করা হতো। ১৯৪০ সালে তার বনস্পতি গল্পটি ক্রান্তি পত্রিকায় ছাপা হয়। তার ইঁদুর গল্পটি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ ঢাকার বুদ্ধিজীবী, লেখক ও বামপন্থি বুদ্ধিজীবীরা শহরে ফ্যাসিবাদবিরোধী এক সম্মেলন আহ্বান করেন। সম্মেলনের দিন সকালে উদ্যোক্তাদের অন্যতম তরুণ সাহিত্যিক সোমেন আততায়ীর হাতে নিহত হন।

সরেজমিনে বালিয়া গ্রাম ঘুরে জানা গেছে, সোমেন চন্দ হত্যা-পরবর্তী সময়ে তার স্বজনদের বেশির ভাগই ভারতে চলে যান। এর ফলে তাদের বেশির ভাগ জমি ক এবং খ তফসিলভুক্ত হয়ে যায়। এই সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল সেই জমি জোর করে দখল করেছে।

সোমেন চন্দের ভাতিজা আশীষ কুমার বলেন, অনেক দূর-দূরান্ত থেকে লেখক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকরা তাকে জানতে বাড়িতে আসেন। কিন্তু তেমন কোনো স্মৃতিচিহ্ন দেখতে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যান। তিনি বলেন, প্রভাবশালীরা আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি দখল করতে করতে এখন বাড়ি-ভিটায়ও হাত দিচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, সোমেন চন্দের স্মৃতি সংরক্ষণ করতে ২০১৭ সালের প্রথমদিকে নরসিংদী জেলা প্রশাসক ও পলাশ উপজেলা প্রশাসন বাড়িটি দেখতে আসেন। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন বাড়িটি সংরক্ষণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। প্রাচীন বাড়িটি ২০১৮ সালের প্রথমদিকে উত্তরাধিকার দাবিদাররা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়।

সোমেন চন্দ পাঠাগারের প্রধান উদ্যোক্তা ও সভাপতি শহিদুল হক সুমন বলেন, ভারতবর্ষের প্রগতিশীল কথাসাহিত্যিক সোমেন চন্দ জন্মগ্রহণের পর থেকে পলাশ উপজেলায় তার পৈতৃক বাড়িতে বসবাস করেছেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর সরকারিভাবে স্থানীয় প্রশাসন কোনো স্মৃতি সংরক্ষণ করেনি। এমন কি সোমেন চন্দের বসবাসের পৈতৃক বাড়িটিও অবহেলা আর বেদখলের কারণে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তাই আমি নিজের পৈতৃক জমিতে নিজ উদ্যোগ ও অর্থায়নে সোমেন চন্দ পাঠাগার করেছি। তিনি বলেন, বিজ্ঞানভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ার পাশাপাশি ভারতবর্ষের প্রগতিশীল লেখক-বাংলা সাহিত্যের কথাসাহিত্যিক সোমেন চন্দ সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের মাঝে স্মৃতিস্বরূপ তুলে ধরতেই এই প্রচেষ্টা। তিনি স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, সোমেন চন্দের পৈতৃক অনেক জমি রয়েছে। সরকারিভাবে সেই জমিগুলো উদ্ধার করে একটি সংরক্ষণশালা ও পাঠাগার তৈরির জোর দাবি জানান।

এ ব্যাপারে পলাশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, সোমেন চন্দের বিষয়টি আমার জানা নেই। এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close