এন কে বি নয়ন, ফরিদপুর

  ২১ এপ্রিল, ২০২৪

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য কাচারিঘর

ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার গুনবহা গ্রামের কাজী বাড়ি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য গ্রামীণ ঘর

ব্রিটিশ আমলের ভারত থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত বাংলা অঞ্চলের অবস্থা সম্পন্ন ব্যক্তিদের ঐতিহ্যের প্রতীক ছিল কাচারিঘর। কিছু সংখ্যক মানুষ কাচারিঘর নির্মাণে টিন ব্যবহার করলেও অধিকাংশরাই ব্যবহার করতেন ছন। তখনকার দিনে ছনের ঘর ছিল আরামদায়ক। কাচারিঘরগুলো মূল বাড়ি থেকে একটু বাইরে তৈরি করা হতো। এমনই এক ঐতিহ্যবাহী কাচারিঘরের সন্ধান মিলেছে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার গুনবহা ইউনিয়নের গুনবহা গ্রামের কাজী বাড়িতে। এটি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য গ্রামীণ ঘর এটি।

শতবর্ষী এ কাচারিঘরটি কালের আবর্তনে জৌলুস হারালেও তার আছে গৌরবময় ইতিহাস। আছে নানা লোক কাহিনি। এই কাচারিঘরে এসেছেন, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লী কবি জসিমউদদীন, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, ভারতের শিক্ষামন্ত্রী কবি হুমায়ুন কবীর, চৌধুরী ইউসুফ আলী মোহন মিয়া। তবে সবচেয়ে বেশি এই বাড়িতে যিনি এসেছেন, তিনি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ ছাড়া ঐতিহাসিক কাচারিঘরে এসেছেন, বঙ্গবন্ধুর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাল প্রধান কৌশলী আবদুস সালাম খান, বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের ডাক ও তার প্রতিমন্ত্রী কে এম ওবায়দুর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী এম এ মজিদ খান, বর্তমান সরকারের বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী কর্নেল ফারুক খান, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমত কাদীর গামা, তার বড় ভাই বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের ফরিদপুর ১০নং আসনের সংসদ সদস্য নুরুল কাদীর জুনু, একই সংসদের ৪নং আসনের এমপি অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন, প্রখ্যাত অভিনেতা অমল বোসের ছোট বেলার অভিনয়ের রিহার্সালের সূতিকাগার ছিল এই কাচারিঘর।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে আত্মগোপনে থাকার অনেকটা সময় এই কাচারিঘরে কেটেছে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুর রহমান, বিএনএমের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহ মো. আবু জাফরও ছাত্র জীবনে এই কাচারিঘরে অনেকটা সময় কাটিয়েছেন। 

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, পঞ্চাশের দশকেও এ অঞ্চলটা ছিল বৃহত্তর যশোর জেলার অন্তর্গত। গুনবহা কাজী বাড়ির সন্তান কাজী আবদুল হক ছিলেন একাধারে কয়েকবারের নির্বাচিত জেলা চেয়ারম্যান ও কংগ্রেস দলের জেলা সভাপতি। কাজী আবদুল হক সাহেবের বড় ভাই কাজী আবদুল মজিদের উদ্যোগে বাড়িতে একটা ছনের আটচালা কাচারিঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কথিত আছে, কাচারিঘরটি তৈরি করতে কয়েক সেট মিস্ত্রি তিনি বদল করেছিলেন। সর্বশেষ একদল মিস্ত্রি তাদের অস্ত্রপাতি ধার দিতে সময় নিয়েছিলেন ৬ সপ্তাহ অর্থাৎ ৪২ দিন। বাঁশের সাজ, বেতের বাঁধন, শাল-সুন্দরীর খুঁটি আর ছনের ছাউনিতে কাচারিঘর দাঁড় করাতে সময় লাগে কয়েক বছর। প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে শত শত লোক আসত কাচারিঘর নির্মাণের কাজ দেখতে। 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শতবর্ষী সেই কাচারিঘরটি আজ আর নেই। ছন এবং কারিগরের অভাবে আটচালা কাচারিঘরটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। তবে বহু স্মৃতিময় ভিটায় প্রায় ৪০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে টিনের প্রতীকী কাচারিঘর। সেই সময়ের কিছু সাল কাঠের খুঁটি, কাঠ ও রড এখনো স্মৃতি হিসেবে রয়েছে। কাচারিঘরটিতে এখন আর আড্ডা, গল্পগুজব, বৈঠক কিছুই হয় না। জমির ফসল ও পরিবারের বিভিন্ন জিনিসপত্র রাখা হয়। যা অনেকটা অযত্ন-অবহেলায় পুরোনো স্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে এই কাচারিঘরের জৌলুস ও উপযোগিতা না থাকলেও ছনের কাচারিঘরে এসেছেন, ব্রিটিশ ভারতসহ দেশের স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ। 

জানা গেছে, আগেকার দিনে মুসলিম পরিবারের কাচারিঘর হিন্দু সমাজে বৈঠকখানা থাকত। এখানেই চলত সামাজিক সালিশ-দরবার, বিয়ের অনুষ্ঠান, পথচারীদের রাত্রি যাপন, এমন কী গ্রামবাসী এসব জায়গায় বসেই আঞ্চলিক বা জাতীয় পর্যায়ের মনোনয়ন বা ভোটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। আজকে যেমন ঘরে ঘরে টিভি বা হাতে হাতে বিনোদন মাধ্যম, দেশ স্বাধীনের পূর্ব থেকে স্বাধীনতাত্তোর আশির দশক পর্যন্ত গ্রামের মানুষের বিনোদনের অন্যতম স্থান ছিল গ্রামের বিত্তবানদের বাড়ির কাচারিঘর। ওখানে পুঁথিপাঠ, লুডু, বাঘবন্দিসহ নানা খেলায় সময় পার করতো গ্রামের এক শ্রেণির বেকার এবং বয়স্ক ব্যক্তিরা। বাড়ির ভেতর থেকে তাদের জন্যে আসত নাশতা। খাবার সময়ে খাবারও আসত মাঝে মধ্যে। নব্বইয়ের দশকে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং আকাশ সংস্কৃতির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কাচারিঘরের ফুরিয়ে গেছে।

ওই বাড়ির সন্তান কবি ও সাংবাদিক কাজী হাসান ফিরোজ বলেন, কাচারিঘরটি ছিল আমাদের শৈশবের বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দু। গরমের রাতে মনে হয়েছে গ্রামটাই কাচারিঘরে ওঠে এসেছে। আমাদের শৈশবে আবদুর রহমান, শাহ মো. আবুজাফরের মতো নেতাদের কাছের থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। আবদুর রহমান ভাই ছিলেন আমাদের পরিবারের সদস্যের মতো। ন্যাপ ভাসানী নেতা অ্যাডভোকেট মিঞা সাদেকুর রহমান তো ছিলেন একই গ্রামের সন্তান এবং কাজী আবদুল হক সাহেব ছিলেন তার হাই স্কুলের শিক্ষক। 

তিনি বলেন, আমার ছেলে বেলায় ৭০ এর নির্বাচনে দেখেছি আবদুস সালাম খান সাহেব ভোট চাইতে এসেছেন। তিনি ওই বাড়ির ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন। তিনি এলে কাচারিঘর থেকে বাড়ির দুই সন্তান আবু দায়েন কাজল (জিয়া ও এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ছাত্রনেতা ও জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি, সরকারি ইয়াছিন কলেজের ভিপি), কাজী ইমদাদুল হক লুলু (জিয়া ও এরশাদবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র নেতা, বোয়ালমারী সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি, বোয়ালমারী উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি) সুর তুলতেন, ইলিশ মাছের ত্রিশ কাঁটা, বোয়ালমাছের দাড়ি, সালাম পাগলা চাকর খাটে শেখ সাহেবের বাড়ি। আমরা তখন অনেক ছোট হলেও তাদের সঙ্গে সুর মিলাতাম।

তিনি আরো বলেন, কালের আবর্তে কাচারিঘরের স্থান দখল করেছে, বাড়ির ড্রইং রুম আর কমিউনিটি সেন্টার। এই কাচারিঘর প্রাঙ্গণে প্রতি বছর নাটক থিয়েটার হতে দেখেছি। কাচারিঘর বিলুপ্তির সঙ্গে মহল্লার মানুষে মানুষে আন্তরিকতারও ঘাটতি হয়েছে।

এ ব্যাপারে গুনবহা কাজী বাড়ির সন্তান এনজিও ব্যক্তিত্ব, সোসাইটি ডেভেলপমেন্ট কমিটির (এসডিসি) নির্বাহী পরিচালক কাজী আশরাফুল হাসান বলেন, শত বছরের পুরোনো কাচারি ঘরটি এখন আর নেই। তবে এখন যে কাচারিঘরটি আছে তার বয়সও প্রায় ৪০ বছরের মতো। ছোটকালে পুরোনো কাচারিঘরটি আমি নিজে দেখেছি তখন আমার বয়স প্রায় ২০ বছর। সেই কাচারিঘরের কিছু স্মৃতি চিহ্ন এখনো আছে। তবে ওই সময়ের কিছু সাদাকালো ছবি থাকলেও এখন আর নেই, নষ্ট হয়ে গেছে। 

ঘোষপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দীন আহমেদ জানান, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মাগুরা মহকুমার একটি আসনের আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রার্থী ছিলেন এম এ খালেক (সাবেক মন্ত্রী), তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন যুক্তফ্রন্টের মৌলভী কফিল উদ্দিন (কংগ্রেসের ভলেন্টিয়ার)। সেই নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান (মুজিব ভাই) টুঙ্গিপাড়া থেকে বাইসাইকেল চালিয়ে গুনবহা থেকে কাজী মুজিবুর রহমানকে সঙ্গে করে ময়না ইউনিয়নের ঠাকুরপুর বাজারে জনসভা করেন। সেখান থেকে দলীয় নির্বাচনী প্রোগ্রামে যোগ দিতে বাইসাইকেল চালিয়ে যান কামারখালী। কামারখালী যাত্রায় সহযোগী ছিলাম আমি এবং কাজী মজিবর রহমান (নবু কাজী)। খালেক সাহেব ১৮৮ ভোটে জয়লাভ করেন। এম এ খালেক সাহেব এই কাচারিঘরে এসেছেন। মৌলভী কফিল উদ্দিন সাহেবের এটা ছিল ফুফার শ্বশুরবাড়ি। অপ্রিয় হলেও সত্য, কফিলউদ্দিন সাহেবের ফুফার শ্বশুরবাড়ির কেউ তার সমর্থক ছিলেন না। তারা করতেন আওয়ামী মুসলিম লীগ।

এ ব্যাপারে বিএনএমের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মো. আবু জাফর বলেন, এই বাড়িতে এবং কাচারিঘরটিতে মহান ব্যক্তিদের আগমন ঘটেছে। আমি নিজেও কাচারি ঘরটিতে অনেক সময় কাটিয়েছি। আমার অনেক স্মৃতিও রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুর রহমান বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কাল রাত্রে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যা হবার পর বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে থাকার অনেকটা সময় এই কাচারিঘরে কেটেছে। 

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close