রবিউল আলম ইভান, কুষ্টিয়া

  ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

কুষ্টিয়া সদর

অভিযুক্তরা ফের বালু তুলছেন পদ্মায়

কুষ্টিয়ায় সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় চার মাস বন্ধ থাকার পর পদ্মা নদীতে ফের অবৈধভাবে বালু উত্তোলন শুরু হয়েছে। এতে বদলে যাচ্ছে নদীর স্বাভাবিক প্রকৃতি। ভেঙে যাচ্ছে পাড়ের ফসলি জমি ও বসতবাড়ি। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা ও জেলা প্রশাসন ‘অবৈধ’ বললেও বালু তোলা বন্ধে নৌ-পুলিশের কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে যুক্ত আছেন একাধিক ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানসহ প্রভাবশালীরা।

জানা গেছে, ২০২৩ সালের ২৯ মার্চ এক আদেশে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ থেকে পাবনার পাকশী পর্যন্ত পদ্মা নদীয় বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ করেন বিচারপতি জে বি এম হাসান ও রাজিক আল জলিলের বেঞ্চ। পদ্মা নদীর কুষ্টিয়া এলাকাও এই আদেশের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু প্রভাবশালীরা সেই আদেশ অমান্য করে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসছে। এদিকে গত বছরের ২০ অক্টোবর অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে নদীতে হামলার শিকার হন ৬ সাংবাদিক। সে বিষয়ে সাংবাদিকদের করা মামলা এখনো চলমান। এরপর বন্ধ হয়ে যায় বালু উত্তোলন। চার মাস বিরতি দিয়ে চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে আবারও বালু উত্তোলন শুরু করে ওই প্রভাবশালী চক্র।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বিগত বছরের মতো এবারও কুষ্টিয়ার হাটশ হরিপুর সংলগ্ন পদ্মা নদী থেকে বালু তোলা হচ্ছে। পদ্মার এই পয়েন্টে প্রতিদিন অনেক নৌকায় বসানো ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করছে। এই বালু শতাধিক বড় নৌকায় বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যাচ্ছে। এই পয়েন্টে এক পাশে কুষ্টিয়া জেলার সীমানা, অন্য পাশে পাবনা। পদ্মায় অবৈধভাবে বালু তোলার ফলে পাবনা পাড়ে ভেঙে যাচ্ছে শত শত বিঘা কৃষিজমি।

কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার হরিপুর এলাকার আতাহার মন্ডল বলেন, প্রতিদিন আমাদের ফসলসহ খেত ভেঙে যাচ্ছে। ভাঙতে ভাঙতে নদীর পাড় হয়ে গেছে ৩৫ হাত পর্যন্ত। বাবু মেম্বার বলেন, কলাগাছ, ধান, সবজি ও খেসারি খেত ভেঙে চলে গেছে নদীতে। কৃষক খাদিম বলেন, আমার কলাখেত ভেঙে গেছে। জমি ও ফসল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেলাম।

সদর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের পদ্মার তীরবর্তী বাসিন্দারা বলেন, পদ্মায় অবৈধভাবে বালু তোলার ফলে ফসলি জমির ভেঙে গেলেও প্রতিবাদ করারও উপায় নেই। কথা বললেই বন্দুকের মুখে পড়তে হচ্ছে। একই ধরনের মন্তব্য করেন পদ্মার ওপাড়ের পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার তীরবর্তী বাসিন্দারা।

স্থানীয় লোকজন ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য মতে, এবার বালু তোলায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাংবাদিকদের করা মামলার আসামি ও কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার তালবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল হান্নান মণ্ডল, জেলার ভেড়ামারা উপজেলার বাহাদুরপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. সোহেল রানা পবন, পাবনার দোগাছি ইউপি চেয়ারম্যান আলী হাসান, কুষ্টিয়া স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ইয়াছির আরাফাত তুষারসহ কয়েকজন।

অভিযোগ বিষয়ে লক্ষ্মীকুণ্ডা নৌ-পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমদাদ হোসেন বলেন, ‘শুনেছি তারা বালু তোলার বৈধ কাগজপত্র করেছে।’ এ ব্যাপারে পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলতে বলেন তিনি। পাবনা নৌ-পুলিশ সুপার রুহুল কবির বলেন, ‘একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বাস ট্রেডার্স, টনি ও খান এন্টারপ্রাইজসহ পাঁচটি কোম্পানিকে ১২টি পয়েন্টে বালু উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।’ তবে ওই রিটের তথ্য, নাম্বারও দিতে পারেননি তিনি।

অন্যদিকে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক এহেতেশাম রেজা বলেন, পদ্মায় বালু তোলা শতভাগ অবৈধ। তিনি বলেন, ‘একটি লিভ টু আপিলের কাগজ দেখিয়েছেন বালু উত্তোলনকারীরা। যে কোর্ট বালু উত্তোলন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন, সেই কোর্টই এটি ডিসপোজাল করবে। তার মানে এই না যে, বালু তুলতে বলছে। এছাড়া বিআইডব্লিউটিএর একটি আইনগত মতামত এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, উন্নয়নমূলক কাজের জন্য বালু উত্তোলনের ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকায় বাণিজ্যিকভাবে বালু উত্তোলনের কোনো সুযোগ নেই।’

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল হান্নান ও আলী হাসানকে ইউনিয় পরিষদের তথ্য বাতায়নে দেওয়া মোবাইল ফোন নাম্বারে একাধিকবার কল করেও তাদের যায়নি। আরেকজন ইউপি (বাহাদুরপুর) চেয়ারম্যান সোহেল রানা পবন বলেন, ‘আমি হাটশ হরিপুর অঞ্চলে পদ্মা নদীতে বালু উত্তোলন করি না। ওখানে বালু উত্তোলন করেন হান্নান মণ্ডলরা।’

এদিকে বালু উত্তোলন বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশে উপজেলাভিত্তিক মনিটরিং টিম গঠন করে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন। এতে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) আহ্বায়ক এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রকৌশলী, সহকারী কমিশনার (ভূমি), থানার ওসি ও নৌ-পুলিশের পরিদর্শককে সদস্য করে কমিটি করা হয়।

এ রকমটি একটি তদারকি দলে আহ্বায়ক ভেড়ামারার ইউএনও আকাশ কুমার কুণ্ডু বলেন, ‘কয়েকদিনে আমরা দুজনকে কারাদণ্ড দিয়েছি। অভিযান চলমান আছে। বালু তুললেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসন জানায়, চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারিও বালু উত্তোলন ঠেকাতে অভিযান চালানো হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি বালু উত্তোলনের দায়ে চারজনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসক এহেতেশাম রেজা বলেন, ‘পদ্মা নদীটি দুই জেলার সীমানার মাঝামাঝি পড়ায় কুষ্টিয়া থেকে অভিযান চালালে বালু উত্তোলনকারীরা নৌকা রেখে পাবনার দিকে পালিয়ে যায়। তাই আমরা দুই জেলা মিলে যৌথ অভিযানের কথা ভাবছি।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close