নিজস্ব প্রতিবেদক

  ৩১ জানুয়ারি, ২০২৪

কমছে খেজুরগাছ, হারাচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্য

ভোরের কুয়াশার মধ্যে শীতে জবুথবু হয়ে কাছি (মোটা দড়ি) ও বেতের ঝুড়ি কোমরে বেঁধে গাছিরা ছুটে চলতেন গ্রামের পথ থেকে পথে। ঝুড়ির ভেতরে থাকত কয়েক রকমের গাছ কাটার ছেন, বালি রাখার চুঙ্গা, রসের হাঁড়ি বা ঠিলা আর দায়ে ধার দেওয়ার বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম। শীতের শুরুতেই গাছ ছিলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন গাছিরা। কোমরে দড়ির সঙ্গে ঝুড়ি (টোনা) বেঁধে ধারালো দা দিয়ে নিপুণ হাতে গাছ চাঁচাছোলা ও নলি (খিল) বসানোর কাজ করতেন। শীতজুড়ে চলতো এ কার্যক্রম। পরে খেজুরগাছ থেকে সুস্বাদু রস সংগ্রহ চলত। আর শীতের সকালে হাটে বাজারে ও জনবহুল রাস্তার মোড়ে মোড়ে সারি সারি খেজুরের রসের ভরা কলস নিয়ে বসে থাকতেন তারা। ছেলে বুড়োসহ সব বয়সি মানুষ রস কিনে নিতেন। ঢাকার নবাবগঞ্জ এবং মঠবাড়িয়ার সদর, আমড়াগাছিয়া, সাপলেজা, তুষখালী, বেতমোর, মিরুখালী ও বড় মাছুয়া ইউনিয়নে এমন দৃশ্য দুই এক দশক আগেও দেখা যেত। কিন্তু এখন আর চোখে পড়ে না সেই দৃশ্য। দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে খাঁটি খেজুরের রস। ব্যাপকহারে খেজুর গাছ কাটার জন্য এমন পরিস্থিতি বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে এবং রাস্তাঘাট সংস্কারের জন্য ব্যাপকহারে খেজুরগাছ কাটা হচ্ছে বলে জানান তারা। এতে হারাতে বসেছে এই অঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী খেজুরগাছের রস ও পাটালি গুড়।

এদিকে গাছিরা জানান, কাজটি পেশা হিসেবে নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ শীত মৌসুম ছাড়া এই কাজ হয় না। এছাড়া কমে গেছে খেজুরের গাছ। তাই পেশাদার গাছিদের সংখ্যা কমে গেছে। কালের পরিক্রমায় ঢাকার নবাবগঞ্জে রসের সঙ্গে হারাতে বসেছে খেজুরগাছ সম্পৃক্ত পেশা-গাছি।

মঠবাড়িযার গাছিরা জানান, খেজুরগাছ বর্গা নিয়ে রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করতেন অনেকে। ওই সময় খেজুরের রস বিক্রি হতো প্রতি কেজি ৮-১০ টাকা। বর্তমানে তা ৫০ থেকে ৮০ টাকা, অনেক জায়গায় ১০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। রসের কলস বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়।

শীত ঋতুতে ঘরে ঘরে খেজুরের রস দিয়ে ফিরনি, পায়েস, রসের গুড় দিয়ে তৈরি হত ভাঁপা পিঠা। গাঢ় রস দিয়ে খাওয়া চলত মুড়ি, চিঁড়া, খই ও চিতই পিঠা। হরেকরকম পিঠাপুলির উৎসব চলত। আর রস জ্বালাতে আগে থেকেই খড়কুটা, পাতা আর শুকনো লাকরি সংগ্রহ করতেন গৃহবধূরা। খেজুরের রস আগুনে জ্বাল দিয়ে বানানো হতো নলেন গুড় ও পাটালি গুড়।

খেজুরগাছ হারিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে লোকজন মনে করছেন ইটভাটার জ্বালানির জন্য ব্যাপকহারে খেজুরগাছ কাটা হচ্ছে। এছাড়া গ্রামের রাস্তাঘাট সংস্কারের জন্যও এসব গাছ কাটা হচ্ছে। কিন্তু নতুন করে আর খেজুরগাছ রোপণ করা হচ্ছে না। ফলে খেজুরগাছ ও খেজুরের রস ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। তবে এখনো রাস্তার আশপাশে হাতেগোনা কিছু খেজুরগাছের দেখা মেলে।

মঠবাড়িয়া উপজেলার বেতমোর রাজপাড়া গ্রামের গাছি ফারুক হোসেন (৪৫) জানান, আগে তাদের দারুণ কদর ছিল, মৌসুম শুরুর আগ হতেই কথাবার্তা পাকা হতো কার কটি খেজুরগাছ কাটতে হবে। কিন্তু এখন আর কেউ ডাকে না। আগের মতো তেমন খেজুরগাছও নেই। তার কিছু কিছু গাছ আছে। যেগুলো কেটে রস সংগ্রহ করছি।

একই এলাকার গাছি জামাল ফরাজি (৫২) জানান, রাস্তাগুলো সংস্কার এবং ইট পোড়ানোর কাজে খেজুর গাছ কেটে ফেলা হলেও নতুন করে আর কেউ গাছ লাগাচ্ছে না। খেজুরগাছ যে হারে নিধন হচ্ছে সেভাবে রোপণ করা হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছর পর গ্রামে আর খেজুরের রস পাওয়া যাবে না। সরকার যদি গ্রামের রাস্তাগুলোর পাশে নতুন করে খেজুরগাছ রোপণের উদ্যোগ নেয়। তাহলে মানুষ আগের মতো হয়ত খেজুরের রস খেতে পারবে।

মঠবাড়িয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান জানান, নিজ উদ্যোগে খেজুরগাছ রোপণ না করে কালের বিবর্তনে খেজুর রস হারিয়ে যাবে। ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বেশি বেশি খেজুরগাছ রোপণ করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।

নবাবগঞ্জের বক্তরনগর গ্রামের গাছি আনোয়ার ও খালেক জানান, গাছ ছিলা থেকে রস সংগ্রহ পর্যন্ত ৮ থেকে ১০ দিন সময় লাগে। বিশেষ কৌশলে বাঁশের তৈরি খিল-চুঙ্গি বসানোর পর মাটির হাঁড়ি পেতে সুস্বাদু এ রস সংগ্রহ করা হয়। গাছ থেকে রস বের করতে প্রতিদিন গাছের কিছু অংশ ছেঁচে ফেলা হয়।

তারা আরো বলেন, এক সময় কাঁচা রস খেতে লোকজনের ভিড় লেগে থাকত। কিন্তু নিপাহভাইরাসের কারণে এখন আর কেউ কাঁচা রস কিনে খায় না। এতে বেচাকেনাও কমে গেছে।

নবাবগঞ্জের গ্রামের রাস্তা সংস্কার ও নতুন খেজুরগাছ রোপণে মানুষের আগ্রহের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে খেজুরের রস। একসময় খেজুর রসে তৈরি নানা ধরনের পিঠাণ্ডপায়েশ ছিল এ অঞ্চলের ঐতিহ্য। কালের আবর্তে শীতের ঐতিহ্য এখন প্রায় অধরা।

ওই এলাকার কয়েকজন গাছি জানান, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুরগাছ ধীরে ধীরে কমে যাবে। তালগাছ রোপণের মতো খেজুরগাছ রোপণে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ থাকলে খেজুরগাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে। না হলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু খেজুরগাছের রস, হারিয়ে যাবে গ্রাম বাংলার আরো একটি ঐতিহ্য। প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে জুলফিকার আমীন সোহেল, মঠবাড়িয়া ও ইমরান হোসেন সুজন, নবাবগঞ্জ (ঢাকা) এর রিপোর্ট অনুযায়ী।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close