নিজস্ব প্রতিবেদক

  ৩১ জানুয়ারি, ২০২৪

তুমব্রু সীমান্তে ফের গোলাগুলি, আতঙ্ক

মিয়ানমারে জান্তা সরকারের সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর চলমান সংঘাতে সীমান্তবর্তী নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, তুমব্রু এলাকায় এক দিনের জন্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর ফের সেখানে প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যায়। এতে ওই এলাকায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

এর আগে ঘুমধুম এলাকার পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে স্বাভাবিক হয়ে আসায় মঙ্গলবার বন্ধ ঘোষিত পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং একটি উচ্চ বিদ্যালয় ও একটি মাদরাসা খুলে দেওয়া হয়। মঙ্গলবার সকালে কোনো গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়নি। পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসার মধ্যেই ফের সংঘাত শুরু হয়।

গতকাল মঙ্গলবার সকালে ঘুমধুম সীমান্তে দুপুরের দিকে রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনো ধরনের গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়নি বলে নিশ্চিত করেছেন ঘুমধুম ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আজিজ। তিনি জানান, সকাল থেকে এখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক। বান্দবান্দরবান জেলা শিক্ষা অফিসার মুহাম্মদ ফরিদুল আলম হোসাইনী জানান, সীমান্তের উত্তেজনা কিছুটা কমার কারণে সাময়িক বন্ধ হওয়া ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয় এবং সীমান্তের ১০০ গজ দূরত্বে থাকা মিশকাতুন নবী দাখিল মাদরাসা খুলে দেওয়া হয়। তিনি জানান, সীমান্তের পরিস্থিতি গতকাল মঙ্গলবার স্বাভাবিক হওয়ায় শিক্ষা কর্যক্রম চলছে তবে নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনা করে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।

প্রসঙ্গত মিয়ানমারে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সীমান্তে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান। তিনি গত রবিবার (২৮ জানুয়ারি) বিজিবির কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের (৩৪ বিজিবি) অধীন, উখিয়ার পালংখালী বিওপি এবং নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু বিওপি ও ঘুমধুম সীমান্ত এলাকা এবং টেকনাফ ব্যাটালিয়নের (২ বিজিবি) অধীন হোয়াইক্যং বিওপি ও তৎসংলগ্ন সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করে এ নির্দেশনা দেন।

বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারে আরকান আর্মি ও আরএসও বিদ্রোহী গোষ্ঠী সঙ্গে মিয়ানমার জান্তা সরকারের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘাত চলছে। সংঘাত চলাকালে সীমান্তবর্তী বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও তুমব্রু এলাকায় গোলাগুলির শব্দ শোনা যায় এবং কামানের গোলা এসে পড়ে। এতে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সতর্ক থাকে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, গত সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমধুম সীমান্তের কাছে কোনো প্রকার গোলাবারুদ বা মর্টার শেলের শব্দ শোনা যায়নি। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে আবারও থেমে থেমে গোলাবারুদের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে সেখানে মর্টার শেল ও গোলা নিক্ষেপ করা হচ্ছে, সেটা সীমান্ত থেকে দুই-তিন কিলোমিটার দূরে হতে পারে। ঘুমধুম সীমান্তবর্তী পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান সোমবার বন্ধ রাখা হলেও মঙ্গলবার পাঠদান শুরু হয়। পরিস্থিতি দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে বান্দরবান জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মুহাম্মদ ফরিদুল আলম হোসাইনী জানিয়েছেন।

বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন বলেন, সীমান্ত পরিস্থিতির ওপর কঠোর নজরদারি ও সজাগ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে ফের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হবে। তাছাড়া পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রধান শিক্ষকরাও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এটা শিক্ষকদের বলা হয়েছে।

সীমান্তে বসবাসরত স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সীমান্তের কাছাকাছি না হলেও মিয়ানমারের ভেতরে সংঘাত তীব্র হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে বিদ্রোহী আরকান আর্মি ক্রমাগত মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যাচ্ছে আর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ক্রমাগত পেছনে যাচ্ছে। সীমান্ত থেকে সাত-আট কিলোমিটার ভেতরে সংঘর্ষ হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।

বিজিবির পাশাপাশি সীমান্ত এলাকায় পুলিশ টহল বাড়ানো হয়েছে বলে বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন জানিয়েছেন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান জানান, মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি।

মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মির এ সংঘর্ষ শুরু হয় দেড় বছর আগে। ২০২২ সালে জুলাই থেকে শুরু হয়ে টানা ছয় মাস যুদ্ধ চলে সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী বাহিনীর মধ্যে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উদ্বেগ, প্রত্যাবাসনে ছন্দপতন

মিয়ানমারের অভ্যন্তরে নতুন করে সংঘাতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কক্সবাজারে উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও জান্তা সরকারের সংঘাতে সেদেশের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের আশঙ্কা তাদের। এতে ফের বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে এবং প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উখিয়ার লম্বাশিয়া ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইউনুছ বলেন, মিয়ানমারের মংডু ও আকিয়ার শহরের আশপাশের গ্রামে এখনো চার-পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা আছে। বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর সেখানে জান্তা বাহিনী বোমা বর্ষণ, নির্যাতন করছে। এতে অনেকেই হতাহত হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা অনেকেই গ্রাম ছেড়ে পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়ার খবর আসছে।

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবাইর বলেন, মিয়ানমার আমাদের একবার গণহত্যা চালিয়ে দেশ ছাড়া করেছে। তখন বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে।

রাখাইনে সংঘাতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ থমকে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা অনেক এগিয়ে গিয়েছিল। তার ছন্দপতন হয়েছে। সংঘাত হয়তো দীর্ঘমেয়াদি হবে না। আশা করি, পরে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের একটি আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর জন্য প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে হবে, যেন কোনোভাবেই নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ না হয়।

অপরদিকে, কচিন ইনডেপেন্ডেস আর্মি (কেআইএ)সহ মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী পিছু হটার পর সে দেশের জান্তা সরকারের সেনাসদস্যরা উত্তরাঞ্চলের সান রাজ্যের মমেইক শহর পুনর্দখল করেছে। এ সময় জান্তা বাহিনী শহরের অন্তত ৮ নাগরিককে হত্যা করে এবং বাড়িঘরে আগুন দেয়। কেআইএ, অল বার্মা স্টুডেন্টস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এবিএসডিএফ) এবং পিপলস ডিফেন্স ফোর্স গত ১৮ জানুয়ারি ওই এলাকায় হামলা চালায় এবং ২৫ জানুয়ারি পুলিশ স্টেশনসহ শহরটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর জান্তা বাহিনী পিছু হটে। এ ঘটনার পর ফের তারা শহরটির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এরপর তারা স্থানীয়দের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। থাইল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের সাংবাদিকদের দ্বারা পরিচালিত গণমাধ্যম ‘দি ইরাবতী’র একটি রিপোর্টে গতকাল মঙ্গলবার এসব কথা বলা হয়েছে।

এর আগে গত সোমবার বিদ্রোহী জোটের স্নাইপারের গুলিতে মিয়ানমার জান্তার শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তাসহ চার সেনা নিহত হন। থাই সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের থিনগানিনাউং শহরের একটি সেনাঘাঁটিতে হেলিকপ্টারটি অবতরণের সময় ওই হামলার ঘটনা ঘটে। ওই সেনাঘাঁটির কাছে মিয়াওয়াদ্দি শহরের দখল নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে সেনা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে লড়াই চলছে।

থাইল্যান্ডে নির্বাসিত মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি নাগরিকদের পরিচালিত ওই সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে আরো জানিয়েছে, নিহত সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার স্তরের। তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী এবং হেলিকপ্টারের দুই পাইলটও নিহত ব্যক্তিদের তালিকায় রয়েছেন। তবে হেলিকপ্টারে থাকা আরো দুই সেনা অফিসার বেঁচে গিয়েছেন। বিদ্রোহী জোটের অগ্রগতি রুখতে গত সপ্তাহে রাখাইন প্রদেশের জনবসতিপূর্ণ এলাকায় নির্বিচার বোমাবর্ষণ শুরু করেছিল মিয়ানমারের বিমানবাহিনী। সোমবারের হামলাকে তারই ‘জবাব’ বলে মনে করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের তিন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ‘তাঙ ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি’ (টিএনএলএ), ‘আরাকান আর্মি’ (এএ) এবং ‘মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি’ (এমএনডিএএ)-র জোট ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়্যান্স’ নভেম্বর থেকে সে দেশের সামরিক জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিল। ওই অভিযানের পোশাকি নাম ‘অপারেশন ১০২৭’। বিদ্রোহীদের হামলার জেরে এরই মধ্যে সে দেশের অর্ধেক এলাকা সরকারি সেনার হাতছাড়া হয়েছে। জান্তাবিরোধী যুদ্ধে শামিল হয়েছে, ‘চিন ন্যাশনাল আর্মি’ (সিএনএ) এবং চায়নাল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্স (সিডিএফ), ‘কাচিন লিবারেশন ডিফেন্স ফোর্স’ (কেএলডিএফ), পিপল’স ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ)-এর মতো বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোও। মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি শক্তির স্বঘোষিত সরকার ‘ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট’ এবং জান্তাবিরোধী রাজনৈতিক দল ‘শান স্টেট প্রোগ্রেস পার্টি’ বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। এই রিপোর্ট তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন উখিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি কায়সার হামিদ মানিক এবং নাইক্ষ্যংছড়ি (বান্দরবান) প্রতিনিধি মোহাম্মদ ইউনুছ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close