নিজস্ব প্রতিবেদক

  ৩০ জানুয়ারি, ২০২৪

খরচে আর পোষায় না বাসা ছাড়ছেন তারা

নতুন সম্ভাবনা সামনে নিয়ে শুরু হয় নতুন বছর। আর এই নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে ভাড়াটিয়াদের বাসা পরিবর্তনের চিত্র। কোনো ভাড়াটিয়া পিকআপে করে, কেউ ট্রাকে, কেউ কেউ ভ্যানগাড়িতে মালামাল নিয়ে বাসা পরিবর্তন করে অন্য এলাকায় চলে যাচ্ছেন। নতুন বছরের শুরু থেকেই এ চিত্র বেশি চোখে পড়ছে। কী কারণে তাদের বাসা পরিবর্তন, জানতে চাইলে অধিকাংশ জানিয়েছেন, বেড়েছে বাসা ভাড়া, যা বহন করা কষ্টসাধ্য। তাই তারা একটু দূরে বা ভেতরের দিকে চলে যাচ্ছেন, যেখানে ভাড়া তুলনামূলক একটু কম। বাড়তি বাড়ি ভাড়ায় তারা আর পোষাতে পারছেন না। সঙ্গে আছে মূল্যস্ফীতির চড়া বাজারদর।

ভুক্তভোগীদের একজন মিরপুরের বাসিন্দা সাব্বির আহমেদ। চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া থাকেন শেওড়াপাড়া এলাকার একটি বাসায়। তৃতীয় তলার সেই ফ্ল্যাটে ভাড়া দেন ১৪ হাজার টাকা।

বছরের শুরুতেই তিনি বাড়ির মালিকের কাছ থেকে ভাড়া বাড়ানোর নোটিস পেয়েছেন। বলা হয়েছে, আগামী মাস থেকে ভাড়া বাড়বে ১ হাজার টাকা। এর ফলে শুধু বাড়ি ভাড়া দাঁড়াবে ১৫ হাজার টাকা। সেই সঙ্গে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, ময়লার বিল সবমিলিয়ে যুক্ত হবে আরো প্রায় ৩ হাজার টাকা। অর্থাৎ তার ভাড়া বাসাকেন্দ্রিক খরচ বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১৮ হাজার টাকা। অথচ মাস শেষে তিনি বেতন পান ৩০ হাজার টাকা। অর্থাৎ তার আয়ের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে বাসা ভাড়া পরিশোধে। এ ছাড়া বর্তমান ঊর্ধ্বগতির বাজারে সংসার পরিচালনা করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে সাব্বির আহমেদকে। তার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হলো বাসা ভাড়া বৃদ্ধির খড়্গ।

সবমিলিয়ে সাব্বির আহমেদ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সামনে দু-এক মাসের মধ্যে বাসা ছেড়ে দেবেন, চলে যাবেন আফতাবনগরের একেবারে ভেতরের দিকে। এ অবস্থা শুধু সাব্বির আহমেদের একার নয়। রাজধানীর বড় একটি জনগোষ্ঠী এ সমস্যার মুখোমুখি।

সাব্বির আহমেদ বলেন, আমার অফিস কারওয়ানবাজার। সেখান থেকে দূরে শেওড়াপাড়া এসে বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম খরচ কমের জন্য। প্রথমে ১০ হাজার টাকায় ভাড়া বাসায় উঠেছিলাম, কয়েক বছরে ভাড়া বেড়ে ১৪ হাজার টাকা হয়েছিল। এখন আবার ভাড়া বাড়িয়ে ১৫ হাজার টাকা করতে চায় বাসার মালিক। যেটা আমার পক্ষে বহন করা খুব কঠিন। আমার মতো যারা কম টাকার বেতনের চাকরির ওপর নির্ভরশীল, তাদের জন্য এত টাকা বাসা ভাড়া দেওয়া খুব কষ্টের।

তিনি আরো বলেন, বর্তমান বাজারে সবকিছুর দাম এতটা বেশি যে, প্রতি মাসেই চলে টানাপোড়েন। এর মধ্যে বাসা ভাড়া বাড়ানোর নোটিস যেন আমার জন্য মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে এ এলাকা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আফতাবনগরের একদম ভেতরের দিকে ১১ হাজার টাকায় একটি বাসা দেখেছি, সেদিকেই চলে যাব। সেখান থেকে চলাচলে কষ্ট হবে ঠিকই, কিন্তু কিছু করার নেই। বর্তমান অবস্থায় বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে করতে আমি দিশেহারা।

শুধু সাব্বির আহমেদ নন, রাজধানীতে বসবাসকারী মধ্যম ও নিম্নআয়ের মানুষের সবার বলতে গেলে একই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

একাধিক ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জীবনযাত্রার ব্যয় ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা অবস্থা। সেই সঙ্গে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধিতে অসহায় হয়ে পড়েছেন মধ্যম ও নিম্নআয়ের মানুষ। যে কারণে কম ভাড়ার আশায় একটু দূরে বা ভেতরের দিকে বাসা স্থানান্তরের প্রবণতা বেড়েছে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৬ গুণের বেশি, যা শতাংশ হিসেবে দাঁড়ায় ৬২৮। এ ছাড়া গত ২৫ বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ এ সময়ে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ।

সংগঠনটির আরেক পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা বাসা ভাড়া পরিশোধে ব্যয় করেন।

মূলত, চাকরি করতে আসা অথবা বেকার, ভাগ্যান্বেষী, বিদ্যান্বেষীসহ নানা শ্রেণির মানুষের ‘স্বপ্ন গড়ার শহর’ এই ঢাকা। সেজন্য দিন দিন এই নগরে মানুষ বাড়ে জ্যামিতিক হারে। এই সিংহভাগ মানুষের বাসস্থানের চাহিদা পূরণ করতে হয় ভাড়া বাসার মাধ্যমে। কিন্তু এই বড় অংশের মানুষ অসহায় হয়ে থাকে বাড়ির মালিকদের কাছে। নতুন বছরসহ নানা অজুহাতে তারা বাসা ভাড়া বাড়িয়ে দেন। এ ছাড়া ভাড়ার তুলনায় বাড়ির সেবা, পরিবেশ কখনোই পান না এসব অসহায় ভাড়াটিয়ারা। বাড়ির মালিক একপ্রকার জিম্মিদশায় রাখেন বলেও অভিযোগ রয়েছে ভাড়াটিয়াদের।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close