অধ্যাপক (ডা.) মনজুর হোসেন

  ০৮ এপ্রিল, ২০২১

শিশুর হৃদ্রোগ

গর্ভ অবস্থা থেকেই শিশুকে নিয়ে মা-বাবা বেশ চিন্তিত থাকেন। কিন্তু এই চিন্তা যখন বাস্তবে রূপ নেয়, তখন মা-বাবার ঘুম হারাম হয়ে যায়। শিশুদের জন্মগত রোগের মধ্যে হৃদ্রোগ অন্যতম, যার শুরু মায়ের গর্ভ থেকেই। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি এক হাজার জীবিত শিশুর মধ্যে আট শিশু জন্মগত হৃদ্রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এ এক হাজার জনের আটজনের মধ্যে আবার দুই থেকে তিনজনের রোগের লক্ষণ জন্মের প্রথম ছয় মাসের মধ্যেই নানা উপসর্গসহ প্রকাশ পায়। বাকিদের পরবর্তী সময়ে জীবনের যেকোনো সময় তা প্রকাশ পেতে পারে। আর আমাদের দেশে গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর ২৫ থেকে ৩০ হাজার শিশু জন্মগত হৃদ্রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। যাদের চিকিৎসা করতে হিমশিম খেতে হয়। আবার অনেক গরিব রোগীর বাবা-মা চিন্তায় প্রায় পাগলের মতো হয়ে যান। কিন্তু এত চিন্তিত না হয়ে আমাদের দেশে সরকারি হাসপাতালে এর চিকিৎসার সুব্যবস্থা আছে।

শিশুর জন্মগত হৃদ্রোগ কী? : মায়ের গর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় শিশুর হৃদ্যন্ত্র তৈরি ও বিকশিত হওয়ার প্রাক্কালেই যদি কোনো ধরনের ত্রুটি হয় এবং শিশু সেই হৃদ্যন্ত্র নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়, তবে তাকে জন্মগত হৃদ্রোগ বলে। অনেক সময় একে শিশুর হার্টে ফুটা বা ছিদ্র আছে এমন শব্দ ব্যবহার করা হয়।

কারণ : জন্মগত শিশু হৃদ্রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে গর্ভাবস্থায় ও গর্ভ পরিকল্পনাকালীন সময়ে বিভিন্ন ওষুধ, রাসায়নিক দ্রব্য, রেডিয়েশন, মায়ের ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ, প্রভৃতি রোগ, গর্ভাবস্থায় মায়ের রুবেলা সংক্রমণ ইত্যাদির সঙ্গে শিশু হৃদ্রোগের যোগসূত্র পাওয়া যায়। এ ছাড়া জেনেটিক কিছু রোগ যেমন ডাউন সিনড্রোম, টারনার সিনড্রোম নিয়ে জন্মানো শিশুরা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

হৃদ্রোগের যেসব লক্ষণ : জন্মের পর থেকেই ঘন ঘন ঠান্ডাকাশি ও শ্বাসকষ্ট, মায়ের বুকের দুধ টেনে খেতে অসুবিধা ও অল্পতেই হাঁপিয়ে যাওয়া, হাত ও পায়ের আঙুল ও ঠোঁটে নীলাভ ভাব, ওজন ও শারীরিক বৃদ্ধির অপ্রতুলতা ইত্যাদি।

জন্মের পরই মায়েদের যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখা উচিত : ১. শিশুটির জন্মের পর পরই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কি না।

২. ভীষণ রকমের কালচে বা নীলাভভাব তার ঠোঁটে বা চামড়ায় দেখা যাচ্ছে কি না।

৩. শিশুটির হার্টবিট যদি অস্বাভাবিক ধরনের কম বা বেশি হয় অথবা ছন্দবদ্ধ না হয়ে অস্বাভাবিকভাবে চলে।

৪. বাচ্চাটি জন্মগ্রহণ করার পর মায়ের দুধপান করার সময় হাঁপিয়ে যায় কি না।

৫. অল্প অল্প দুধপান করে ক্লান্ত হয়ে ছেড়ে দিয়ে আবার কিছু সময় পর দুধপান করছে কি না।

৬. দুধপান করার সময় শিশুটি অস্বাভাবিক ধরনের ঘামছে অথবা শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।

৭. শিশুটি অন্যসব বাচ্চার মতো ওজনে বাড়ছে না।

৮. জন্মের পর থেকেই শিশুর বারবার ঠান্ডা-কাশি লেগেই আছে কি না এবং সে কারণে বারবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে বা ডাক্তারের কাছে যেতে হচ্ছে।

৯. শিশুটি কান্নার সময় অস্বাভাবিক রকমের কালো হয়ে যায় এবং একই সঙ্গে শ্বাসকষ্ট হয়। একটু বড় বাচ্চা খেলার সময় দৌড়াদৌড়ি করলেই কালো হয়ে যায়, শ্বাসকষ্ট হয় এবং উপুড় করে শুইয়ে দিলে বা বড় বাচ্চারা হাঁটু গেড়ে বসলে তাদের স্বস্তি আসে। বড় বাচ্চাদের কখনো কখনো বুকে ব্যথা, বুক ধড়ফড় করা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদিও হতে পারে।

ওপরের যেকোনো একটি লক্ষণ দেখা দিলেই শিশুকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।

রোগ নির্ণয় বা পরীক্ষাগুলো : সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করতে পারলে বেশির ভাগ হৃদ্রোগ চিকিৎসায় ভালো হয়।

একটি মাত্র পরীক্ষা যদি করা হয় রোগ শনাক্তের জন্য তাহলে সেটা হলো কালার ডপলার ইকো কার্ডিওগ্রাফি। আমাদের দেশে প্রায় সব ভালো হাসপাতালে, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ইকোকার্ডিওগ্রাফি পরীক্ষা হয়। এ ছাড়া চেস্ট এক্স-রে, ইসিজি, হলটার মনিটরিং, ক্যাথ স্টাডি, কার্ডিয়াক সিটি স্ক্যান, এমআরআই ইত্যাদি চেকআপ করা হয়।

চিকিৎসা : সাধারণত ওষুধের মাধ্যমে, ইন্টারভেনশন বা বিনা অপারেশনে রক্তনালির মাধ্যমে ও সার্জারি বা অপারেশন এ তিনটি পদ্ধতির মাধ্যমে শিশুদের হার্টের চিকিৎসা করা হয়।

শিশুদের জন্মগত হৃদ্রোগ প্রতিরোধে করণীয় :

* মহিলাদের রুবেলা টিকা দেওয়া।

* গর্ভাবস্থায় যথাযথ পরিচর্যা এবং ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি পূরণ করা।

* গর্ভাবস্থায় রাসায়নিক পদার্থ ও তেজস্ক্রিয়তা থেকে সতর্ক থাকা।

* গর্ভধারণের আগেই ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, খিঁচুনি জাতীয় রোগে আক্রান্ত মায়েদের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।

শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। শিশুর সুন্দর, সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন আমাদের সবার কাম্য। তাই জন্মের শুরু থেকেই শিশুদের দিকে বাবা-মায়ের বিশেষ যতœ নেওয়া অপরিহার্য।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close