লে.কর্নেল নাজমুল হুদা খান, এমফিল, এমপিএইচ

  ০৬ জানুয়ারি, ২০২২

ইংরেজি নববর্ষের ইতিবৃত্ত 

সবাইকে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা। সময়ের পরিক্রমায় আরেকটি বছর আমাদের অতীত হয়ে গেল। অতীত, বর্তমান ভবিষ্যতের মধ্যে পার্থক্যকারীকে আমরা সময় হিসেবে অভিহিত করে থাকি। মাত্রা, কাল-স্থান বিশেষে প্রকাশের ভিন্নতা রয়েছে। বাস্তবিকার্থে সময়ের ক্ষুদ্রতম একক ১০-২৪ সেকেন্ড বা সেপ্তালিওন্থ হলেও প্রয়োগের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রতর ১০-১৮ বা এটো সেকেন্ড ব্যবহার হয়ে থাকে। কালের আবর্তে মিনিট, ঘণ্টা, দিন, সপ্তাহ, পক্ষ, মাস, বছর, অধিবর্ষ, দশক, যুগ হীরক বা রজতজয়ন্তী, শতাব্দী কিংবা সহস্রাব্দ ইত্যাদি শব্দগুলোর মাধ্যমে সময়ের মাত্রা প্রকাশ করার প্রচলন রয়েছে। সময়ের মাত্রার প্রভেদ শুধু নাম ব্যবহার এরমধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; দেশে দেশে এসব মাত্রাগুলো সংস্কৃতি, উৎসব, পালা পার্বণেও রূপ নেয়। এসবের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ইংরেজি নববর্ষ উৎসব। বিশ্বের ইতিহাসে একদিকে যেমন প্রায় সব দেশে একই দিনে ইংরেজি নববর্ষ পালিত হয়; অন্যদিকে এখনো অনেক দেশে ভিন্ন তারিখে নববর্ষ উদযাপনের প্রচলন রয়েছে কিংবা কোনো কোনো দেশে তা পালনই করা হয় না।

বর্তমানে পৃথিবীর বেশির ভাগ স্থানে জানুয়ারির তারিখে ইংরেজি নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। এটি প্রকৃতপক্ষে জুলিয়ান এবং পরবর্তীতে গ্রেগোরিয়ান প্রবর্তিত বর্ষপঞ্জির অনুসরণেই উদযাপন করা হয়ে থাকে। কবে থেকে পৃথিবীর মানুষ বর্ষবরণ শুরু করে, তা নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও প্রায় চার হাজার বছর আগে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ খ্রিস্টাব্দে মেসোপটেমীয় সভ্যতায় (বর্তমান ইরাক) প্রথম বর্ষবরণ চালুর বিষটি ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য। এরমধ্যে ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় বর্ষবরণ প্রথা প্রথমে চালু হয়। তবে তখন ইংরেজি নববর্ষের ন্যায় জানুয়ারির তারিখে তা উদযাপিত হতো, তা কিন্তু নয়। ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় নববর্ষ পালন করা হতো বসন্তের প্রথম দিনে। যেদিন বসন্তের প্রথম চাঁদ উঠত, শুরু হতো বর্ষবরণ। মেসোপটেমীয় সভ্যতা নববর্ষ পালনের পর রোমানদের খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩ সাল থেকে জানুয়ারি নববর্ষ পালন করার ইতিহাস রয়েছে।

এখন নজর দেওয়া যাক, ইংরেজি বর্ষের গণনা ক্রমপঞ্জির দিকে। ইতিহাসবিদদের মতে, মানুষ প্রাচীন যুগে চাঁদের হিসেবেই বর্ষ গণনা শুরু হয়। তাতে ঋতুর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না এবং বছর হিসাব করা হতো ১০ মাসে। সূর্যের সঙ্গে মিল রেখে বছর গণনা শুরু হয় বহু দিন পর থেকে; যার সঙ্গে ঋতুর সম্পর্ক রেখে বর্ষপঞ্জিকা তৈরি শুরু হয় মিসরের সুমেরীয় সভ্যতা।

মিসরীয় সভ্যতায় পৃথিবীর প্রাচীনতম সৌর ক্যালেন্ডার প্রচলন হয়েছিল বলে মত রয়েছে। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ৪২৩৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ক্যালেন্ডার প্রথা শুরু হয়। রোমানরা গ্রিকদের প্রবর্তিত ক্যালেন্ডার ব্যবহার শুরু করে। রোমের প্রথম সম্রাট রোমুলাসই খ্রিস্টপূর্ব ৭৩৮ সালে চাঁদের হিসাব অনুযায়ী রোমান ক্যালেন্ডার প্রচলন করেন। সে ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ ছিল মার্চ আর ক্যালেন্ডার বছর হিসাব করা হতো ১০ মাসে। পরবর্তীতে সম্রাট নুমা পন্টিলাস ১০ মাসের সঙ্গে জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি মাস দুটি যোগ করেন। তবে রোমানদের ক্যালেন্ডারের কোনো তারিখ ছিল না। চাঁদ ওঠার পর ধীরে ধীরে বড় হওয়ায় ছবি দিয়ে মাসের বিভিন্ন দিনকে চিহ্নিত করা হতো। যেমন চাঁদ ওঠার সময়কে বলা হতো ক্যালেন্ডস, পুরো চাঁদকে ইডেস, মাঝামাঝি অবস্থানকে বলা হত নুনেস। পরবর্তীতে সম্রাট জুলিয়াস সিজার প্রক্রিয়ার পরিবর্তন ঘটান। তিনি ক্যালেন্ডস, ইডেস, নুনেস স্থানগুলোতে সংখ্যা বসিয়ে দেন। যেহেতু চাঁদের হিসাবে মাস ২৯ দিনে, ফলে চাঁদের হিসাবে ৩৫৫ দিনে এক বছর হয়। কিন্তু চাঁদের হিসাবে মাস বছর গণনার ক্ষেত্রে চাষি বা ব্যবসায়ীরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হন। সব সমস্যা সমাধানকল্পে সম্রাট সিজার মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া থেকে জ্যোতির্বিদ মোসোজিনিসকে নিয়ে এসে ক্যালেন্ডার সংস্কারের উদ্যোগ নেন। মোসোজিনিস সমস্যা সমাধানকল্পে চাঁদের পরিবর্তে সূর্য দেখে বর্ষ গণনার পরামর্শ দেন। মোসোজিনিস দেখতে পান যে, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণ করতে সময় নেয় ৩৬৫ দিন ঘণ্টা। তার পরামর্শমতে, সম্রাট সিজার খ্রিস্টপূর্ব ৭০৮ সালে চাঁদের পরিবর্তে সূর্যের হিসাবে বছরে ৩৬৫ দিন ধরে ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন। ছাড়া প্রতি চার বছর পর প্রতি বছরের অতিরিক্ত ঘণ্টা যোগ করে ২৪ ঘণ্টা অর্থাৎ এক দিন বাড়িয়ে লিপইয়ারের প্রচলন শুরু করেন।

যেহেতু প্রাচীন রোমানদের হাতেই মূলত ক্যালেন্ডারের প্রচলন ঘটে, তাই ইংরেজি ১২ মাসের বেশির ভাগই নামকরণ করা হয় রোমান দেবতা, সম্রাট, লাতিন শব্দ, সংখ্যা অনুসারে, যেমন- . জানুয়ারি- রোমান দেবতা জানুসের নামানুসারে, জানুস অর্থ দুটি মুখ। . ফেব্রুয়ারি-লাতিন শব্দ ফেবরুয়া (অর্থ পবিত্র) থেকে উৎপত্তি। . মার্চ- রোমান দেবতা মার্সের নামানুসারে; মার্স হলো রোমানদের যুদ্ধ দেবতা। এজন্য রোমানরা মার্চ মাসকে বর্ষ শুরুর মাস হিসাবে উদযাপন করত। . এপ্রিল- লাতিন এপ্রিলিস থেকে এপ্রিল মাসের নামকরণ। যার অর্থ খোলা। . মে- বসন্তের দেবী মায়াসের নামানুসারে। . জুন- বিবাহ নারীদের কল্যাণের দেবী জুনোর নামানুসারে জুন মাসের নামকরণ করা হয়। . জুলাই- খ্রিস্টপূর্ব ৭০৮ সালে রোমান ক্যালেন্ডারের সংস্কারক রোম সম্রাট জুলিয়াস সিজারের নামানুসারে মাসের নামকরণ করা হয়। . আগস্ট- জুলিয়াস সিজারের ছেলে এবং পরবর্তীতে রোম সম্রাট আগস্টাস সিজারের নামানুসারে। . সেপ্টেম্বর- লাতিন সংখ্যা VII (Septem) থেকে সেপ্টেম্বরের উৎপত্তি। ১০. অক্টোবর- লাতিন সংখ্যা অষ্টম (VIII) বা Octo অনুকরণে অক্টোবর মাসের নামকরণ। ১১. নভেম্বর- লাতিন IX ( নবম) বা Novem থেকে নভেম্বর মাসের নামকরণ করা হয়। ১২. ডিসেম্বর- লাতিন সংখ্যা X ( দশম) বা Decem থেকেই ডিসেম্বর মাসের নাম দেওয়া হয়।

১৫৮২ সালের পোপ গ্রেগোরি প্রবর্তিত ক্যালেন্ডার ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে রোমের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগোরী (প্রকৃত নাম উগো বনকমপাইনি, ইটালির বেলোনিয়ার বংশদ্ভূত) জুলিয়াস বর্ষপঞ্জির সংস্কারে হাত দেন। রোম সম্রাট জুলিয়াস সিজার যে বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করেন তাতে প্রতি বছর ছিল ৩৬৫ দিন ঘণ্টা, কিন্তু এর আসল সময় ৩৬৫ দিন ঘণ্টা ৪৫ মিনিট। ফলে সামান্য পার্থক্যের কারণে ১৩ বছর পর মহাবিষুব তারিখ ১০ মার্চ থেকে পিছিয়ে পৌঁছায় ২১ মার্চ। বিষয়টি সংশোধনে গবেষণার কাজে সহযোগিতা করেন রুম চিকিৎসক পঞ্জি বিশারদ আলোয়সিউস লিলিয়াস এবং জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার ক্লাডিয়াস। গ্রেগোরী তাদের সুপারিশক্রমে ১৫৮২ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি জুলিয়ান বর্ষপঞ্জির সংশোধন জারি করেন এবং ১৫৮২ সালের অক্টোবর মাসের অক্টোবর শুক্রবার না হয়ে ১০ দিন এগিয়ে ১৫ অক্টোবর শুক্রবারকে প্রবর্তন করেন। তার নামে বর্ষপঞ্জি পরিচিতি পায় গ্রেগোরিয়ান বর্ষপঞ্জি হিসেবে। বিভিন্ন মতভেদ, অসন্তোষ দেখা দেওয়ায় সংশোধিত গ্রেগোরিয়ান প্রথা সার্বজনীনভাবে বিভিন্ন দেশে চালু হতে প্রায় ১০০-২০০ বছর পার হয়ে যায়। তদুপরি এখন পর্যন্ত গ্রেগোরী প্রবর্তিত ক্যালেন্ডার মোটামুটি নিখুঁত হিসেবে গণ্য করা হয়। ফলে বিশ্বব্যাপী এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে। বর্তমানে আমরা যে ক্যালেন্ডার অনুসরণে ইংরেজি নববর্ষ পালন করি, তা গ্রেগোরিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসরণেই করে থাকি।

লেখক : সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা

জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা, ঢাকা

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নববর্ষের ইতিবৃত্ত,ইংরেজি,গ্রেগোরিয়ান,জুলিয়ান
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close