জিনাত জান কবীর

  ০৮ মার্চ, ২০২১

স্বেচ্ছাসেবী হিসেবেও পিছিয়ে নেই নারী

মহামারিকালে অসহায় মানুষের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করছেন বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির এক নারী স্বেচ্ছাসেবী

আপনজনরা যখন কোভিড রোগীদের বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন এবং মৃত স্বজনের দাফন বা সৎকার না করে রাস্তায় ফেলে গেছেন, ঠিক সেসময় দেশে মানুষের জন্য কাজ করছেন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রায় ৪ হাজার স্বেচ্ছাসেবী। ওই স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে প্রায় ৩০০ নারী। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সারা দেশে জনগণের মধ্যে সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে বেসিন স্থাপন করাসহ সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করেছেন। এ ছাড়া হাসপাতাল, হাটবাজার, মসজিদ, মন্দির, গির্জাসহ জনসমাগমস্থল জীবাণুমুক্ত করতে জীবাণুনাশক ছিটানোর কার্যক্রম এবং মানুষের মনোবল ঠিক রাখতে কাউন্সেলিং করে যাচ্ছেন ওই স্বেচ্ছাসেবীরা। দেশে কোভিডপ্রতিরোধী গণটিকাদান কার্যক্রমেও বড় সহায়ক শক্তি রেড ক্রিসেন্টের ওই স্বেচ্ছাসেবীরা, যাদের মধ্যে অন্যতম নারীরা।

রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবীদের একজন নোয়াখালীর সানজিং মারমা বীথি। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আমি উপকূলীয় অঞ্চলের মেয়ে। এখানে নারীরা এমনিতেই বের হন খুব কম। তার পরও এখানে এর আগে শিক্ষা কার্যক্রম, রক্তের নমুনা সংগ্রহ, ত্রাণ বিতরণ এসব নিয়ে কাজ করেছি। কিন্তু করোনাকালে যখন রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে, লকডাউনের কারণে কেউ বাসা থেকে বের হতে পারছিলেন না, ঠিক সেসময় আমরা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মানুষের বাসায় পৌঁছে দিয়েছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘এখনো আমরা সাধারণ মানুষের করোনা ভ্যাকসিন দিতে সহায়তা করে যাচ্ছি। এলাকার মানুষ আমাদের অনেক প্রশংসা করে এবং ভালোবাসে।’

আরেক স্বেচ্ছাসেবী মরিয়ম বিবি রশ্মনি বলেন, ‘আমি মিরপুর এলাকায় থাকি। করোনাকালে ওই এলাকা লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এ কারণে তখন বাসায় থাকলে বের হতে পারব না আবার বের হলে বাসায় ঢুকতে পারব না। প্রতিবেশীরা জানত যে, আমি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সঙ্গে জড়িত। তারাও বাধা দিচ্ছিল, কারণ আমি করোনায় আক্রান্ত হলে আমার পরিবার এবং তারাও আক্রান্ত হবে। এসব ভেবে সিদ্ধান্ত নিই, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির অফিসে থেকে কাজ করব।’

তিনি আরো বলেন, ‘মানুষের সেবা করতে গিয়ে আমি নিজেও করোনায় আক্রান্ত হই। পরে করোনা নেগেটিভ হলে হাসপাতাল থেকে যখন বাসায় যাই, তখন প্রতিবেশীরা বাসায় ঢুকতে বাধা দিচ্ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যখন তারা আক্রান্ত হলো, তখন তারা প্লাজমা এবং অন্যান্য কাজে আমার সহায়তা চেয়েছে। তারা আক্রান্ত হওয়ার পর দৃশ্য পুরো পাল্টে গেল।’

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবী তাজনূর আহাম্মেদ সেঁওতি বলেন, ‘আমরা মূলত মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে নভেল করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় কার্যক্রম শুরু করি। তখন কেউ ভালো করে জানত না করোনাভাইরাস কী, তা থেকে কীভাবে নিজেকে নিরাপদ রাখা যায়। শুরুতে যখন জনগণকে সচেতন করতে মাইকিং করি, লিফলেট বিতরণ করি। তখন কেউ বিশ্বাস করতে চাচ্ছিল না, করোনা বলে কিছু আছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা যখন জীবাণুনাশক স্প্রে করি, মানুষ বলত মশা মারার ওষুধ নিয়ে আসছে। করোনা বলে যে কিছু আছে, তা জনগণকে বিশ্বাস করানো কঠিন ছিল।’

স্বেচ্ছাসেবী শারমিন আক্তার পাপড়ি বলেন, ‘অদৃশ্য এই করোনাভাইরাস সারা বিশ্বে ছড়িয় পড়লে তা মোকাবিলায় কাজ করা আমার পরিবারের জন্যও চ্যালেঞ্জিং ছিল। শুরুতে অনেকের পরিবার বাধা দিয়েছে। কিন্তু আমরা যেহেতু আগে থেকেই মানুষের সেবা করেছি, বোঝানোর পর বাবা-মা বলতেন, মানুষের সেবায় আমার সন্তান না গেলে কারো না কারো সন্তান তো যাবেই। পরে পরিবারও আমাদের সহায়তা করেছে।’

স্বেচ্ছাসেবী কামরুন নাহার বলেন, ‘রমজানে আমরা ভাসমান মানুষের জন্য নিজেরাই ইফতার তৈরি ও প্যাকেট করতাম। প্রতিদিন নিজেরাই মানুষের কাছে গিয়ে ২৫০-৩০০ প্যাকেট ইফতার বিতরণও করেছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘বিভিন্ন বস্তিতে মানুষ আমাদের জন্য দোয়া করত। তারা আশ্বস্ত হতো। সেসবই আমাদের মানসিক শক্তি জোগাত।’

স্বেচ্ছাসেবী কনিকা বলেন, ‘আমাদের পরিবার মানসিক দিক থেকে বেশ শক্তিশালী। যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলা করে যখন আমরা বাসায় ফিরতাম, পরিবার আমাদের প্রতি আরো মমতাশীল হয়ে উঠত। কিন্তু কাজ শেষে বাসায় যেতে রাত হলে প্রতিবেশীরা নারী বলে খারাপ ধারণা করে।’

তিনি বলেন, ‘এই করোনাকালে মানুষ আগের তুলনায় অনেক বেশি বিষণ্ণ হয়ে পড়েছে। তাদের মনোবল ঠিক রাখতে যতটা সম্ভব ভার্চুয়ালি মানসিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি।’

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির যুব ও স্বেচ্ছাসেবক বিভাগের পরিচালক ইমাম জাফর শিকদার বলেন, ‘আমি স্বেচ্ছাসেবকদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মানসিক শক্তি জুগিয়েছি। সারা দেশে প্রায় ৪ হাজার স্বেচ্ছাসেবক কাজ করেছেন। তার মধ্যে প্রায় ৩০০ নারী স্বেচ্ছাসেবী। নারী স্বেচ্ছাসেবীরা সাহসিকতার সঙ্গে করোনাকালে যে পরিশ্রম করেছেন, সেজন্য তাদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।’

তিনি বলেন, ‘যে সময় সন্তান বাবা-মায়ের মরদেহের সৎকার না করে ফেলে রেখে গেছেন, ঠিক সেসময় আমাদের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির বরগুনা ইউনিটের স্বেচ্ছাসেবীরা মৃতদেহের সৎকারের কাজ করেছেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবকরা বিপদগ্রস্ত-অসহায় মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ওই প্রচেষ্টাই একসময় দেশকে বদলে দেবে, সমাজকে বদলে দেবে, আলোকিত করবে বাংলাদেশকে।’

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
স্বেচ্ছাসেবী,নারী,রেড ক্রিসেন্ট
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close