সাধন সরকার

  ২৮ আগস্ট, ২০২০

করোনাকালেও থামেনি সড়ক দুর্ঘটনা

প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশজুড়ে আন্দোলনের পরও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি! সড়কে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলছেই। মহাসড়কে ধীরগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়নি। আবার সড়কে ঠিকঠাক সাইন-সংকেতও কাজ করছে না। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যেও শৃঙ্খলার অভাব দেখা যাচ্ছে। কেননা বেশির ভাগ মালিক এখনো চালকদের ‘যত টিপ তত টাকার’ ওপর বেতন দিয়ে থাকেন! এতে করে দ্রুত টিপ দিতে সড়কে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন চালকরা। প্রতিদিন সম্ভাবনাময় ও স্বপ্নের অনেক জীবন সড়ক দুর্ঘটনার বলি হচ্ছে।

রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে চালকদের বেপরোয়া যানবাহন চালানো। এ ছাড়া রয়েছে চালকদের নিয়মকানুন মানাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনীহা, গাফিলতি ও অন্যায় করে চালকদের পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি। সরকারের কঠোর পদক্ষেপ, আইনের প্রয়োগ, মালিকপক্ষের দায় ও জবাবদিহিসহ চালকদের মধ্যে আরো বেশি সতর্কতা ও ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করা গেলে সড়ক নিরাপদ থাকবে বলে মনে করি।

করোনাকালেও সড়ক দুর্ঘটনা থামেনি। করোনাকালে জনজীবন কিছুটা স্থবির হয়ে পড়লেও এ অবস্থার মধ্যে চলতি বছরের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত পাঁচ মাসে সড়কে ১ হাজার ২০৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সাত মাসে ২ হাজার ৪৮২ জন সড়কে জীবন দিয়েছেন। এ বছরের প্রথম সাত মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন প্রায় ৪ হাজার। প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ প্রতিদিন সড়কে বলি হলেও এর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণের কোনো বিধান নেই। সড়ক পরিবহন খাতে শুধু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। দাবির মুখে সরকার নিরাপদ সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনও করে। কিন্তু সড়ক নিরাপত্তা আইনের বাস্তবায়নের অনিশ্চয়তা যেন কাটছেই না। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালে যে পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তাও পুরোপুরি মানা হচ্ছে না। পাঁচ দফার মধ্যে রয়েছে—দূরপাল্লার বাসযাত্রায় বিকল্প চালক রাখা, পাঁচ ঘণ্টা পরপর চালক পরিবর্তন করা, চালক ও সহকারীদের প্রশিক্ষণ, চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট রাখা বাধ্যতামূলক, মহাসড়কের পাশে চালকদের জন্য বিশ্রামাগার ইত্যাদি।

তথ্য মতে, বর্তমানে সারা দেশে নিবন্ধিত যানবাহন আছে ৪৪ লাখ আর চালকের মোট সংখ্যা ৩২ লাখ। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে ১৪ লাখ চালক কম আছে, ফলে এই ১৪ লাখই ভুয়া চালক বলা চলে! বেসরকারি হিসাবে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর সাত-আট হাজার মানুষ মারা যায়। তাহলে সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিকার কী? প্রকৃতপক্ষে সড়ক প্রশাসন ভেঙে পড়েছে বলা যায়! সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি দরকার। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের চাপে সড়ক আইনটির বাস্তবায়নের শিথিলতায় প্রতিদিন সড়কে তাজা তাজা প্রাণ কি ঝরতেই থাকবে!

সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, সংস্থা ও সংগঠনকে আরো আন্তরিক হতে হবে। মালিক ও চালকদের অতি লোভ পরিহার করতে হবে। মালিকপক্ষ থেকে চালকদের স্বাভাবিক বিশ্রাম দিতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধে শুধু আইন করলেই হবে না, আইনের পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের পাশাপাশি লাগাতার চেষ্টা ও উদ্যোগ সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারে। যা হোক, সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টেনে ধরতে কিছু বিষয়ে নজর দিতে হবে—১. চালকদের বেপরোয়া মনোভাব ও গতি রুখতে সচেতনতা ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে। ২. চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের পরই কেবল ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান করতে হবে। ৩. সড়কে পুলিশ ও মোবাইল কোর্টকে আরো সক্রিয় করতে হবে। ৪. মহাসড়কে ছোট যান চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। ৫. বিভিন্ন দুর্ঘটনাপ্রবণ মোড় ও ট্রাফিক পয়েন্ট সংস্কার করতে হবে। ৬. গাড়ির গতির ওপর ভিত্তি করে আলাদা লেন করার পাশাপাশি ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে হবে। ৭. বিভিন্ন কোম্পানি না রেখে একটি রুট একটি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। ৮. এ খাতে সব ধরনের চাঁদা বাণিজ্য বন্ধসহ চালকদের চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে। ৯. বেসরকারি খাতের দৌরাত্ম্য কমাতে রাজধানীসহ সারা দেশে আরো বেশি সরকারি আধুনিক গণপরিবহন চালু করতে হবে। ১০. দুর্ঘটনা কমাতে সড়কের ওপর চাপ কমিয়ে রেল ও নদীপথকে কাজে লাগাতে হবে। ১১. সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে এবং ১২. সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পথচারী, চালক-মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

মোদ্দাকথা, আমরা সড়কের নরকীয় তাণ্ডব থেকে সাধারণ মানুষ মুক্তি চায়।

লেখক : পরিবেশকর্মী ও কলামিস্ট

সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)

[email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সড়ক দুর্ঘটনা,করোনা,সড়কে শৃঙ্খলা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close