এস এম মুকুল

  ২৪ আগস্ট, ২০২০

রেনেসাঁ জাগাবে কুটিরশিল্প

বাংলা নববর্ষবরণের সঙ্গে সঙ্গে যে শিল্পটির আঁতুড়ঘরের সম্পর্ক, তার নাম কুটিরশিল্প। প্রাচীন গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্য হিসেবে দেশজুড়ে বছরব্যাপী বিভিন্ন মেলার আয়োজনে সগৌরবে যে শিল্পটি গ্রামীণ অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছে, তাও কুটিরশিল্প। আধুনিক বাংলাদেশের মেলা, উৎসব-পার্বণে অনেক পরিবর্তন এলেও কুটিরশিল্পই সেখানে প্রাধান্য পাচ্ছে। এ যুগের তরুণ-তরুণীরা যারা গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে ধারণাই রাখেন না, তারাও গ্রামীণ কুটিরশিল্পের সামগ্রীতে নিজেদের চিরায়ত পরিচয় খুঁজে বেড়াচ্ছেন, এটি খুবই পজিটিভ দিক। আমাদের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প, বাঁশ-বেত শিল্প, মসলিন, জামদানি, নকশিশিল্প, তাঁতশিল্পের গৌরবময় ইতিহাসের সূতিকাগার এই কুটিরশিল্প এখন অনেকদূর এগিয়ে গেছে মেধা, মননে এবং শৈল্পিকতায়।

দেশব্যাপী কুটির ও হস্তশিল্প খাতের প্রসারের যে ব্যাপক সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে, এ খাতের শিল্প ইউনিট সংখ্যার ক্রমবৃদ্ধিই এর প্রমাণ বহন করে। তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৬১ সালে দেশে কুটির ও হস্তশিল্পের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার, ১৯৯১ সালে ৪ লাখ ৫ হাজার। বর্তমানে পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে দেশে কুটির শিল্পের সংখ্যা ৮ লাখ ৩০ হাজারের অধিক। এ শিল্প ঘিরে কর্মসংস্থান হয়েছে ২৯ লাখেরও বেশি। দেশজ উৎপাদনে কুটির শিল্পের অবদান প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। তবে সময় ও চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক কারুপল্লীর অস্তিত্ব যেমন বিলুপ্ত হয়েছে; তেমনি নতুন নতুন অনেক কারুপল্লী গড়ে উঠেছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে নতুনমাত্রা যোগ হয়েছে এই শিল্পের সঙ্গে। শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা তাদের মেধা ও শ্রম নিয়োজিত করে কুটির শিল্পে নিয়ে এসেছেন নতুন নতুন সংযোজন। যেমন এই শিল্পে যোগ হয়েছে শীতলপাটি, কলাগাছের মন্ড থেকে তৈরি কাগজ, কারুকার্যের টুপি, মাথার চুল, মাছের আছিল, কাঁটা থেকে গবাদিপশুর হাড়গোড় পর্যন্ত ব্যবহৃত হচ্ছে উৎপাদনের পণ্যসম্ভারের তালিকায়। এসব পণ্য রফতানিতে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা; যা এ শিল্পের বিকাশে নতুন সম্ভাবনা ও নতুন আশা জাগিয়েছে।

কুটিরশিল্প এমন একটি শিল্প যাতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রুচির পরিবর্তনকে ধারণ করে আঙ্গিক পরিবর্তন হলেও ঐতিহ্য বহমান থাকে। গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতায় নানা ধরনের নজরকাড়া দৃষ্টিনন্দন অপ্রচলিত পণ্য বর্তমান আধুনিক যুগের উন্নত রুচিশীল প্রজন্মেরও আকর্ষণ কেড়েছে। এই শিল্পের জন্ম ও বিকাশ শহরের তুলনায় পল্লী অঞ্চলে বেশি। অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত জনশক্তিরাই এই শিল্পের উত্থানের নেপথ্য নায়ক। বিভিন্ন জরিপ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে এসএসসির নিচে ৮৩ শতাংশ, এসএসসি থেকে এইচএসসি পর্যন্ত ১৫ শতাংশ এবং মাত্র ২ শতাংশ ডিগ্রি বা তার অধিক। তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কুটির শিল্প থেকে বছরে ৩৯ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকার পণ্য উৎপন্ন হয়। প্রতি বছর ১৭ লাখ কর্মক্ষম লোক যোগ হয় এই শিল্পের সঙ্গে। বিসিকের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কমবেশি এক লাখ হবে।

বিবিএসের জরিপ বলছে, কুটির শিল্প ঢাকা বিভাগে ২ লাখ ৫০ হাজার ১১২টি, সিলেট বিভাগে মাত্র ২৭ হাজার ৭৯১টি, রাজশাহী বিভাগে ১ লাখ ৩০ হাজার ১৩৩টি, খুলনা বিভাগে ১ লাখ ২২ হাজার ৮৭, চট্টগ্রাম বিভাগে ১ লাখ ১৫ হাজার ৯৬৮, রংপুর বিভাগে ৮২ হাজার ৭৪৪ এবং বরিশাল বিভাগে ৫১ হাজার ৪৭০টি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ২৯ লাখ ৬৩ হাজার লোক কাজ করছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের ৯৬ শতাংশই একক মালিকানা এবং ৩ শতাংশ যৌথ মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত। সারা দেশে যত কুটির শিল্প রয়েছে তার ৬৫ ভাগেরই কোনো নিবন্ধন নেই বলে দাবি করছে বিবিএস জরিপ। কারণ কুটির শিল্প করছেন এমন অনেকেই জানেন না যে, তাদের শিল্পটি ক্ষুদ্র হলেও এর নিবন্ধনের প্রয়োজন আছে বা কোথা থেকে নিবন্ধন নিতে হয়। অনেকে যুব উন্নয়ন অধিদফতর আর কেউবা স্থানীয়ভাবে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করেন। যে কারণে উদ্যোক্তারা নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

সৌখিন ভোক্তাদের কাছে কুটির শিল্প পণ্যের কদর বাড়ছে। নান্দনিকতা ও প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি হওয়ার কারণে দেশে ও দেশের বাইরে বিপুল জনপ্রিয়তা কুটির শিল্পভিত্তিক পণ্যসামগ্রীর। কালাবধি কুটির শিল্প গ্রামীণ অর্থনীতির গতিবৃদ্ধিসহ জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আসছে। প্রতি বছর মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কুটির শিল্পের অবদান ৩১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতে মোট উৎপাদিত পণ্যের বাজারমূল্য ৩৯ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। অন্যান্য ব্যয় বাদ দিয়ে এ খাতে সার্বিক মূল্য সংযোজন হয় ৩১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার। জানা গেছে, দেশের জিডিপিতে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প খাতের অবদান ২০ দশমিক ১৭ ভাগ। আর এ খাতের প্রবৃদ্ধির হার ১০ দশমিক ৩২ ভাগ। এর মাঝে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের প্রবৃদ্ধি হার ১০ দশমিক ৭০ ভাগ। এতে এটাই প্রমাণিত হয় দেশ দ্রুত শিল্পায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

আমরা জানি, একসময় আমাদের হস্তশিল্পের বাজার ছিল শুধু ইউরোপের কয়েকটি দেশে। স্বাধীনতা-উত্তর এ খাতে দেশের রফতানি আয় ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৩ মিলিয়ন টাকা। নব্বই দশকে এ খাতের আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২১১ মিলিয়ন টাকায়। তারপর ঊর্ধ্বমুখী কুটির শিল্পের রফতানি বাজার। নতুন নতুন সংযোজন এ শিল্পের সম্ভাবনাকে পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় বর্তমানে বাংলাদেশের হস্ত ও কুটির শিল্পজাত পণ্যের প্রধান বাজার হচ্ছে যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, স্পেন, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফিনল্যান্ড, সুইডেন ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে। এ শিল্প বাজারের পরিব্যাপ্তি বিকাশের গতিধারা সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। তথ্য অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কুটির শিল্পগুলোর বুনিয়াদি অবস্থান গ্রামাঞ্চলকে কেন্দ্র করেই। তবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তরুণ-তরুণীদের মেধাশক্তি, সৃজনী ক্ষমতা আর প্রযুক্তির আলিঙ্গন পেয়ে কুটির শিল্পের সীমানা গ্রাম থেকে মফস্বল—এমন প্রধান শহরগুলোতে ডালপালা মেলেছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোয় উৎপাদিত পণ্যের বাজারমূল্য ৩৯ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা।

ক্ষুদ্র ও কৃটির শিল্প নিয়ে যে প্রতিষ্ঠানটি জনবলের স্বল্পতায় দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে, তার নাম বিসিক বা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন। অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৫৭ সালে প্রথম বিসিকের কার্যক্রম শুরু হলেও ১৯৬০ সালের দিকে বিসিক ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি শিল্পনগরী স্থাপন শুরু করে। বিসিকের দাবি, জিডিপিতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের অবদান ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ৫ দশমিক ২৭ ভাগ আর সেবা খাতে ১০ শতাংশের বেশি। বিসিকের কুটির শিল্পের মধ্যে রয়েছে খাদ্যপণ্য, পানীয়, বস্ত্র ও ক্ষুদ্র পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, কাঠ ও আসবাব, কাগজ থেকে উৎপাদিত পণ্য, তামাকজাত পণ্য, মুদ্রণ, রাসায়নিক ও রাসায়নিক পণ্য, রাবার ও প্লাস্টিক পণ্য, মৌলিক মেটাল ও নন-মেটালিক মিনারেল পণ্য, ইলেকট্রনিকস ও চশমা, ইলেকট্রিক্যাল সরঞ্জাম, পরিবহন সরঞ্জাম, হস্তশিল্প, মেরামত কারখানা, মৌমাছি পালন, লবণশিল্প প্রভৃতি। এসব শিল্পের ৫৬ দশমিক ৩ ভাগ গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত। জানা গেছে, এ শিল্পের বিকাশে ঢাকার কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছাড়াও বিসিকের চারটি আঞ্চলিক কার্যালয়, ৬৪টি জেলা কার্যালয়, ৫৯ জেলায় ৭৪টি শিল্পনগরী, ১৫টি নৈপুণ্য বিকাশ কেন্দ্র এবং তিনটি পার্বত্য জেলার ২২টি উপজেলায় ৩২টি উৎপাদন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র কাজ করছে। বিসিক শিল্পনগরীতে ৮৬৫টি রফতানিমুখী শিল্প ইউনিটে উৎপাদিত পণ্যেও ৫০ ভাগ রফতানি হয়। শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে বিসিকের স্থাপিত ৭৪টি শিল্পনগরীতে ৪ হাজার ২৫৯টি শিল্প-কারখানা উৎপাদনরত আছে; যার মধ্যে সম্পূর্ণ রফতানিমুখী শিল্প ৯৫০টি। এসব শিল্প ইউনিটে ৫ লাখ ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান ও ক্রমপুঞ্জীভূত বিনিয়োগের পরিমাণ ১৯ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা।

শিল্প খাতে রফতানি বৃদ্ধির জন্যই দেশের কুটির ও হস্তশিল্পের প্রসার ঘটানো প্রয়োজন। বিসিক, যুব উন্নয়ন অধিদফতর ও ইপিবিসহ অন্যান্য সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে ট্রেডভিত্তিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরি, উদ্যোক্তা সৃষ্টি, পুঁজি সহায়তা, দেশ-বিদেশে মেলা ও প্রদর্শনীর আয়োজন, উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর বাজার খুঁজে বের করা প্রভৃতি বহুমাত্রিক আয়োজনে কুটির শিল্প বিকাশে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। ভাটি বাংলার হাওর অঞ্চলে ১ কোটির অধিক জনসংখ্যা বছরের ছয় মাস বেকার সময় কাটায়। সরকার যদি কুটিরশিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ নীতি বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়, তাহলে সার্বিকভাবে দেশের অনতিক্রম্য মাধ্যমিক স্তর এবং মাধ্যমিক পাসের শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া তরুণ-তরুণীরাও যুক্ত হবে এই শিল্প খাতের সঙ্গে। মাধ্যমিক পর্যায়ে কুটিরশিল্প পাঠ ও প্রশিক্ষণ উৎপাদনে বহুমাত্রিকতা আসতে পারে। একটি বৃহৎ পরিকল্পনায় অগ্রসর হলে এই কুটিরশিল্প দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে রেনেসাঁ ঘটাবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কুটিরশিল্প,রেনেসাঁ,বিসিক
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close