মোতাহার হোসেন

  ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

গোপন নথি ও গ্রাফিক নোভেল ‘মুজিব’

একটি জাতির জন্ম বা একটি দেশের স্বাধীনতা এক দিনে অর্জন হয় না। বরং একটি জাতি এবং একটি দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে থাকে বহু ত্যাগ, সংগ্রাম, আন্দোলন এবং সুচিন্তিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। জাতি হিসেবে বাঙালির আত্মবিকাশ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুদীর্ঘ ত্যাগের ইতিহাস। রয়েছে তার সঙ্গে নেতৃত্বে থাকা জাতীয় চার নেতা, আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগসহ দেশের লাখ লাখ মানুষের আত্মত্যাগ। যাদের বিপুল ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এ জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দীর্ঘ সময় কাটাতে হয়েছে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে। এমনকি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুর জন্য তার সেলের পাশেই খোঁড়া হয়েছিল কবর। কিন্তু পাক জান্তারা স্বাধীনতাকামী বাঙালির ভয়ে এবং বিশ্ববাসীর চাপের কারণে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিতে পারেনি। স্বাধীনতা অর্জনের নেপথ্যে আরো রয়েছে অনেক অজনা করুণ ইতিহাস।

দেশের স্বাধীনতা অর্জনের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পাকিস্তানি আমলের গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সদ্য প্রকাশিত ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বইয়ে আমাদের মহান স্বাধীনতা অর্জনের অন্যতম দলিল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সম্প্রতি এই ঐতিহাসিক বইটির মোড়ক উন্মোচন করলেন তারই সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গোপন নথির ওপর বইয়ের প্রথম খণ্ড প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তুলে দেন পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শীর্ষক ১৪ খণ্ডের বইয়ের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে।

এই বইয়ের মোড়ক উন্মোচনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্য প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে। তার বক্তব্যে ওঠে আসে, ‘দেশের নির্যাতিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু আন্দোলন করেছেন, আত্মত্যাগ করেছেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করতে বঙ্গবন্ধুকে সময় দেওয়া হয়নি। ৭৫-এ তাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে অমূল্য এসব ডকুমেন্ট দেশ, জাতি ও বহির্বিশ্বে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াসে ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শীর্ষক ১৪ খণ্ডে বই আকারে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হবে। এই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় ভাষা আন্দোলনসহ বাঙালির স্বাধীনতার ধারাবাহিক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসংবলিত বইয়ের প্রথম খণ্ডের (১৯৪৮-১৯৫০) আত্মপ্রকাশ হলো। পরে পর্যায়ক্রমে ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে প্রদত্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তৈরি করা পাকিস্তানের ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের (আইবি) প্রতিবেদন বই আকারে প্রকাশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে এ উদ্যোগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনসহ বাঙালির স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ এবং উজ্জ্বলতর করবে।

তাই বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যমত অনুষঙ্গই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ ২৩ বছরের সেসব গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রচিত ১৪ খণ্ডের এ বই। এ বই প্রকাশ করছে হাক্কানি পাবলিশার্স। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কালক্রমে তার হাত ধরেই বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ। তরুণ শেখ মুজিব নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে কেমন করে বাংলার অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হলেন—সেই পথচিত্র যেমন এ বইয়ে এসেছে, সেই সঙ্গে এসেছে বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে চলার মানচিত্র। এসব কারণে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ সংকলনকে বিশেষজ্ঞরা বর্ণনা করছেন ‘অমূল্য সম্পদ’ হিসেবে। এটা ভুলে গেলে চলবে না, কোনো ব্যক্তির একক ঘোষণায় বাঙালি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। এ ক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় বলা যায়, একমাত্র বঙ্গবন্ধুই ছিলেন বাঙালিকে হাজার বছরের দাসত্ব ও পরাধীনতা থেকে মুক্তি দেওয়ার মতো একমাত্র যোগ্য নেতা। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রদত্ত গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রকাশিতব্য ১৪ খণ্ডের সংকলনে ভাষা আন্দোলন, জমিদারি প্রথা বিলুপ্তকরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন, আওয়ামী লীগের জন্ম, শেখ মুজিবুর রহমানের চিঠিপত্র, বিভিন্ন লিফলেট বিতরণ, বক্তব্য-বিবৃতি, গ্রেফতার, কারাবরণ, কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আত্মীয়স্বজন ও নেতাকর্মীদের সাক্ষাতের বিষয়গুলো উঠে এসেছে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের বয়ানে। ৬০৬-৪৮ ফাইল নম্বর দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে যেসব ক্ল্যাসিফায়েড তথ্য সেখানে ছিল, সেগুলোর পাঠোদ্ধার ও সংকলিত করা হয়। ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ উৎসর্গ করা হয়েছে তার সহযোদ্ধাদের উদ্দেশে।

অবশ্য এর আগে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা প্রভৃতি বই থেকেও বাঙালির স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা, ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস জানতে সহায়ক হবে। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের একটি মহৎ উদ্যোগ ‘গ্রাফিক নোভেল ‘মুজিব’-এর প্রকাশনা। গণবভনে একই দিন শিশু-কিশোরদের উপযোগী করে প্রকাশিত এই গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটি পঞ্চম পর্বের বই। এর আগে আরো চারটি পর্ব প্রকাশিত হয়েছে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যে নামটি তারা মুছে ফেলতে চেয়েছিল, তা আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। সত্যকে কখনো মুছে ফেলা যায় না, সেটা আজ প্রমাণ হয়েছে।’ তিনি রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও তার টিমকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘শুধু বই আকারে নয়, বরং শিশু-কিশোরদের জন্য ও নতুন প্রজন্মের জন্য উপযোগী করে গ্রাফিক নোভেল তৈরি করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রশংসনীয় কাজ করেছে তারা। মুজিব নাম নিয়ে গ্রাফিক নোভেল প্রকাশ করেছে। এটি অনেক বেশি আমাদের শিশু-কিশোরদের আকর্ষণ করছে। আর এভাবেই চেষ্টা করে যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর যে নামটি তারা মুছে ফেলতে চেয়েছিল তা প্রতিষ্ঠার জন্য। কারণ সত্যকে কখনো মুছে ফেলা যায় না, সেটা আজ প্রমাণ হয়েছে।

মুজিব গ্রাফিক নোভেলের পঞ্চম পর্বে দেখা যায়, ১৯৪৫ সালে অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়া সত্যেও শেখ মুজিবুর রহমানকে কীভাবে ছাত্রলীগের পদ থেকে বঞ্চিত করা হয়, এরপর ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আর কোনো নির্বাচন পায়নি ছাত্রলীগ। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং যুদ্ধকে কেন্দ্র করে কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের কালোবাজারির কারণে দেশে অস্থিরতা তৈরি হয়। তার পরবর্তী সময়ে দেশের কিছু এমএলএ এবং খান বাহাদুরদের স্বার্থের টানাপড়েনের কারণে ব্রিটিশ গভর্নরের কাছে ক্ষমতা চলে যায়। এসব কিছু দারুণভাবে নাড়া দেয় তরুণ শেখ মুজিবকে। এর আগে প্রথম পর্বে খেলাধুলা, পড়াশোনা ও চিকিৎসকের কাছ থেকে পালানো এবং প্রথমবারের মতো কারাবরণের মতো বিভিন্ন কৌতূহলোদ্দীপক কাজের পাশাপাশি দেশের প্রতি তরুণ বয়স থেকেই নিজের বিশ্বাসের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিতে দেখা যায় কিশোর শেখ মুজিবকে। দ্বিতীয় পর্বে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির হাতেখড়ির পাশাপাশি তার প্রেরণা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠার বিষয়টি জানা যায়। মুজিব ৩-এ বঙ্গবন্ধুর স্কুল ও কলেজের শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকা- এবং দুর্ভিক্ষের সময় মানবিক ভূমিকার বিষয় উঠে আসে। ‘মুজিব-৪’-এ অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ সম্মেলন শেষে তরুণ শেখ মুজিবের দিল্লির বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ ও ১৯৪৪ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনে তার ভূমিকার বিষয়টি উঠে এসেছে।

‘মুজিব ৫’-এর কাজে নিবিড়ভাবে যুক্ত থেকেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গ্রাফিক নোভেলটি মূলত ১২ পর্বে তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। ‘মুজিব-১’ প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে। এরপর সিরিজের আরো তিনটি বই মুজিব-২, মুজিব-৩ ও মুজিব-৪ প্রকাশিত হয়। এর ধারাবাহিকতায় প্রকাশিত হলো ‘মুজিব-৫’। এর আগে অবশ্য ইতস্ত, বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু প্রকাশনা হয়েছে কিন্তু সেসব গুছানো ছিল না। কিন্তু এবার দেশের শিশু-কিশোর এবং তরুণ প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপনের কাজটি সেভাবে হয়ে ওঠেনি আগে। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক। বঙ্গবন্ধুর ঘটনাবহুল জীবনকে আকর্ষণীয়ভাবে শিশু-কিশোরদের কাছে তুলে ধরার জন্য গ্রাফিক নোভেল বের করার কাজটি শুরু করেন বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক। প্রত্যাশা থাকবে, এসব উদ্যোগের ফলে বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনাহূত-অপ্রত্যাশিতভাবে যেসব বিতর্ক, বিভ্রান্তি বিগত সময়ে করা হয়েছে, অবশ্যই তার অবসান ঘটবে। একই সঙ্গে প্রত্যাশা—এসব প্রকাশনা দেশের শিশু-কিশোরসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষের কাছে পৌঁছানো হবে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
গোপন নথি,মুজিব গ্রাফিক নোভেল,বঙ্গবন্ধু,শেখ মুজিবুর রহমান,আওয়ামী লীগ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close