গাজী শাহনেওয়াজ

  ০১ জুন, ২০১৮

বুড়িমারী স্থলবন্দর গতি পাচ্ছে না

*সংকট উত্তরণে মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ *নেই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা *সংকট মালবাহী ওয়াগনের *পণ্য পরিবহনে জটিলতা

নানা সমস্যার কারণে গতি পাচ্ছে না দেশের বাণিজ্যিক অগ্রযাত্রার সম্ভাবনাময় বুড়িমারী স্থলবন্দর। এই সমস্যাগুলো সমাধান না করলে অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত অবদান রাখা সম্ভব হবে না উত্তরাঞ্চলের এই স্থলবন্দরটির। চাঁদাবাজিসহ অবকাঠামো, সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ ও ব্যবস্থাপনায় নানা সমস্যার কারণে বন্দরটির কার্যক্রম চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এই সংকট থেকে বের হওয়ার কোনো কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। এই নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এই নিয়ে তারা বেশ কয়েকটি সমস্যা চিহ্নিত করেছে, সমাধানের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশও করেছে।

বুড়িমারী স্থলবন্দরের সমাধান খুঁজতে মাঠে নেমেছেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এতে তারা রীতিমতো ভড়কে গেছেন। বন্দরের গতি ফেরাতে তারা যে কয়েকটি সুপারিশ করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে বন্দরকেন্দ্রিক হয়রানি ও চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা অব্যাহত রাখা, বন্দর থেকে মালবাহী ওয়াগন চালু করা, বন্দর থেকে চলে আসা রাস্তাটি পাটগ্রাম হয়ে লালমনিরহাটের দিকে চলে গেছে, সেটাকে ডাবললাইন করা, বন্দরের পুরো কার্যক্রমকে সিসিটিভির আওতায় নিয়ে আসা, ক্র্যাশ মেশিনগুলো প্রতিস্থাপন করা, যাতে মালামাল ওঠানামায় সুষ্ঠু ব্যবস্থা ফিরে আসে। ভারোত্তোলন মেশিন স্থাপন এবং যানবাহনের ডাটাবেস তৈরি করা ইত্যাদি।

গত ২৭ এপ্রিল নৌপরিবহন সচিব মো. আবদুল সামাদের নেতৃত্বে মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধিদল বুড়িমারী স্থলবন্দরটি সরেজমিন পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা বন্দরটি সচল না হওয়ার পেছনে নানা সমস্যা চিহ্নিত করেন। পরে মন্ত্রণালয়ে ফিরে বন্দরটির স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন—এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে গত ১৭ মে জমা দিয়েছে। এতে স্বাক্ষর রয়েছে নৌপরিবহন সচিব মো. আবদুস সামাদের।

স্থলবন্দরটির সমস্যা সমাধানে উপায় কী জানতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিবের সেলফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ভারত ও ভুটানের সীমান্ত লোগোয়া বুড়িমারী স্থলবন্দরটি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে খুবই সম্ভাবনাময়। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সঠিকভাবে পরিচালিত হলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে বন্দরটি। কিন্তু উত্তরাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে স্থাপন করা এই বন্দরটি সেভাবে অবদান রাখতে পারছে না। কারণ বন্দরটির অবকাঠামো উন্নয়নের প্রাথমিক অবস্থায় বড় ধরনের ত্রুটি রেখে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। দেখা গেছে, একটি বন্দর স্থাপনের আগে সুনির্দিষ্ট এলাকা জোনভিত্তিক হওয়া বাধ্যতামূলক, এখানে সেটা মানা হয়নি। এমনকি বন্দর লোগোয়া ছোট ছোট অসংখ্য অপরিকল্পিত বেসরকারি স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এসব স্থাপনাজুড়ে দিন-রাত অবাধে পাথর ভাঙা হচ্ছে, যা পরিবেশকে মারাত্মক দূষণ করছে। সেখানে কর্মরত শ্রমিকরা রয়েছেন ঝুঁকিতে। স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক হারে ফুসফুসজনিত সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে বন্দরটির ভবিষ্যৎ সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে। কারণ মালবাহী বিদেশি ট্রাকগুলো এ বন্দরে ভিড়তে নিরুৎসাহিত বোধ করবে এবং বন্দর সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

একইভাবে, বন্দর লোগোয়া এসব স্থাপনার কারণে ভারতীয় ট্রাক দেশের অভ্যন্তরে প্রায় চার-পাঁচ কিলোমিটার প্রবেশ করছে। ওইসব অপরিকল্পিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে কোনটি দেশি ট্রাক, কোনটি বিদেশি তা প্রশাসনের পক্ষে চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। পরিস্থিতি উত্তরণে নির্দিষ্ট জোন করে দূরবর্তী স্থানে পাথর ক্রাসিংয়ের স্থান নির্বাচন করার সুপারিশ করেছে মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন দল।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বন্দরের কার্যক্রম চলমান থাকলেও অদক্ষ শ্রমিকের মাধ্যমে তা পরিচালিত হচ্ছে। গড়ে উঠেনি দক্ষ শ্রমিকগোষ্ঠী। তাই টেকসই লেবার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম তৈরির ওপর তাগিদ দিয়েছে কমিটি। পাশাপাশি যেসব শ্রমিক এখানে কাজ করবেন তাদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং কাজের ধরন নিয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।

এ ছাড়া বন্দরের সন্নিকটে বুড়িমারী রেলস্টেশন রয়েছে। কিন্তু ওয়াগনের ব্যবস্থা না থাকায় ব্যবসায়ীরা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই ব্যবস্থা সচল হলে সাশ্রয়ী সময়ে এবং স্বল্প খরচে পণ্য পরিবহন করতে পারতেন ব্যবসায়ীরা। বলা হয়েছে, তিস্তা সেতু থেকে ডাবল লেন করা হলে বন্দরের কার্যক্রমে গতি বাড়বে। এর সঙ্গে রেল কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী হলে রেলপথেও মালামাল পরিবহন করা যাবে। তাই বন্দরের গতি ফেরাতে ওয়াগন সুবিধা চালুর সুপারিশ রয়েছে প্রতিবেদনে।

তাছাড়া জেলা শহর থেকে বুড়িমারী বন্দরের যোগাযোগের একমাত্র রাস্তা যা শত বছরের পুরনো ও মালবাহী ট্রাক চলাচলে অনুপযোগী। মালবাহী ট্রাকগুলো অধিক ওজন হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ধীরগতিসম্পন্ন হয়। কিন্তু দূরপাল্লার যানবাহনগুলো যা দ্রুতগতিসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও ট্রাকের লাইন ধরে চলতে হয়। কারণ দুটি গাড়ি পাশাপাশি চলা ঝুঁকিপূর্ণ। এ ধরনের সরু রাস্তা বাণিজ্য সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দিয়েছে, যা কাম্য নয়।

বন্দর সচল রাখতে প্রতিবেদনে আরো কিছু সুপারিশ করা হয়েছে, যার মধ্যে যন্ত্রাংশ স্থাপন করা, ইয়ার্ড বাড়ানোসহ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা লেভেল বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে। আর যাত্রী হয়রানি দূর করতে কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, ব্যাংক, বিজিবি ও বন্দর কর্তৃপক্ষকে এক ছাতার নিচে (নেটওয়ার্ক) আনার সুপারিশ করেছে কমিটি।

উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালে বুড়িমারীতে শুল্কস্টেশনের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১০ সালের ৩০ মার্চ এ শুল্কস্টেশনকে স্থলবন্দরে উন্নীত করা হয়। গত ৩০ বছরে স্থলবন্দরটি স্বাবলম্বী হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বুড়িমারী স্থলবন্দর,বিদ্যুৎ সুবিধা,পণ্য পরিবহনে জটিলতা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist