জোবায়ের রাজু

  ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

ভ্রমর কইও গিয়া...

গুলজার আলী আর মরিয়ম বেগমের দাম্পত্য জীবনের তের বছর পার হওয়ার পরও যখন দুজনই সন্তান দেখার আশা ছেড়ে দিয়েছেন, তখন এক সন্ধ্যায় মরিয়ম বেগম টের পেলেন তার শরীরের ভেতর আরেকটি শরীর বেড়ে ওঠার আগমনী বার্তা। স্বামীকে সুখের খবরটি দিতেই আনন্দে গুলজার আলী কেঁদে দিলেন। সেই রাতে দুজনে আর ঘুমাননি। পূর্ণিমা রাতে উঠোনের পাশে ডালিম তলায় বসে দুনিয়ার গল্পের আসর তুললেন গুলজার আলী। মাঝে মাঝে তার দরদি গলায় গান ছাড়লে মরিয়ম বেগম স্বামীর সুরেলা গলায় পরিচিত সব গানে নিজেকে বিলীন করে দেন।

বিয়ের পর পরই মরিয়ম বেগম জানতে পারলেন তার স্বামীটি এক সময় গান করতেন। গানের সাথে তার আত্মার সম্পর্ক ছিল। সময়ের সাথে সাথে দরিদ্রতার কাছে নিজেকে বলি দিতে দিতে গুলজার আলী গান থেকে সরে এলেন কঠিন বাস্তবতার কাছে। বয়সের বাঁকে এসে বিয়ে নামের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কাজটিও সমাধা করলেন। স্ত্রী হিসেবে পেলেন উদার মনের মরিয়মকে।

দিন যায়। মাস যায়। দুজনের বিয়ের বয়স লম্বা হতে থাকলেও সন্তানের অভিভাবক হওয়ার সুখের খবর পায় না কেউ। কাছের আর দূরের আত্মীয় সকল বংশের বাত্তি দেখার প্রতিক্ষায় প্রহর গোনে। মরিয়ম কাউকেই সুসংবাদ দিতে না পেরে ডাক্তার কবিরাজের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে সময় নষ্ট করলেও কাজের কাজ কিচ্ছু হয় না। নিরুপায় হয়ে মরিয়ম এক সময় মা হওয়ার আশাই ছেড়ে দেন। গুলজার আলী বাবা ডাক শুনবার তীব্র তৃষ্ণায় মনে মনে মরে যান। কাউকে কিচ্ছু না বললেও মরিয়ম স্বামীর গোপন ব্যথা বুঝতেন বলে স্বামীকে আরেকটা বিয়ে করার তাগিদ দেন। স্ত্রীর এমন আবদারে গর্জে উঠে গুলজার আলী ঠাস করে মরিয়মের গালে একখানা চড় বসিয়ে দিয়েই ক্ষ্যাপা গলায় বললেন, ‘তোমার মত এমন লক্ষ্মী বউ আর কে হবে আমার! এমন বউ আমি আর কোথাও পাব না।’ সুখে দুই চোখে পানি এসে যায় মরিয়মের।

বিয়ের আজ তের বছর পর সন্তানের মুখ দেখতে যাচ্ছে দুজন। এ আনন্দ কোথায় রাখে তারা! দিন যাবার সাথে সাথে গুলজার আলী আর মরিয়ম বেগমের সন্তান দুনিয়াতে আসার সময় হয়ে আসে।

শেষ পর্যন্ত কন্যা সন্তানের মা হয় মরিয়ম বেগম। নবজাতকের পবিত্র কান্নার প্রথম বুলিতে গুলজার আলী আনন্দে পাগল হয়ে ওঠেন। বাবা হওয়ার পুণ্যতায় নিজের পুরুষ জীবনকে সার্থক মনে করেন।

মেয়ের নাম রাখা হয় সুমনা। সন্তানকে অতি আদরে বড় করতে থাকেন দুজন। এক পা, দু পা করে সুমনা হাঁটতে শেখে। দৌড়াতে শেখে। মুখে অস্পষ্ট বুলি আসে। খিলখিলিয়ে আসে। প্রাইমারির আঙিনায় যায়। ভালো ছাত্রীর ভূমিকা নিয়ে স্যারদের নজরে আসে। ততদিনে ফাইভ পাস করে হাইস্কুলের আঙিনায় সুমনা।

কোন কোন দিন বাবা গুলজার আলী গান ধরলে কিশোরী সুমনাও বাবার সাথে সুর মেলাত। মেয়ের গলাটা কানে লাগে গুলজার আলীর। বেশ সুরেলা গলা। শুনতে বেশ মিষ্টি লাগে। সুমনারও গানের দিকে এক ধরনের ঘোর আছে।

গুলজার আলী মেয়েকে গানের স্কুলে ভর্তি করালেন। সংগীত গুরু হরিনাথ রায় সুমনার গলায় মুগ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন এই মেয়েকে তিনি বিনামূল্যে গান শেখাবেন। দরিদ্র গুলজার আলী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন হরিনাথ রায়ের কাছে।

ভালো ছাত্রীর পাশাপাশি সুকণ্ঠী হিসেবে স্কুলে সবাই এক নামে চিনে নিল সুমনাকে। ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাস করে সুমনা কলেজেও চলে যায়। নবীনবরণ আয়োজনে কলেজে গান গেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল সেদিন।

জাবেদের প্রেম প্রস্তাব সুমনাকে ভাবিয়ে তুলল। এমন একটা স্মার্ট ছেলে তাকে প্রপোজ করবে, ভাবতেও পারেনি সে। তাই অত গভীরভাবে চিন্তা না করে সুমনা জাবেদকে তার হৃদয় মন্দিরে ঠাঁই দিয়ে দিল। কলেজের ছাদে যখন দুজনের তুমুল অভিসার চলে, জাবেদের অনুরোধে তখন সুমনাকে একের পর এক গাইতে হয়। ভ্রমর কইও গিয়া...সুমনার কণ্ঠে জাবেদের এই গানটা বেশ ভালো লাগে।

বাসায় যখন সুমনা গানের চর্চায় বসে, প্রায়ই এই গানটা ধরে সে। ‘কইও কইও কইওরে ভ্রমর কৃষ্ণরে বোঝাইয়া, মুই রাধা যামু মরে কৃষ্ণহারা হইয়ারে..., গানের এই লাইনটি গাইলে সুমনার প্রতিবার মনে হয় সে সত্যি জাবেদকে ছাড়া

মরে যাবে। যেন যে কোনো কিছুর মূল্যে হোক, জাবেদকে তার জীবনে চা-ই-চাই। সময় আর যৌবন তাকে এমন মাতাল করে তোলে। কিন্তু পুরোপুরি মাতাল হবার আগেই সুমনা জানতে পারে, তার মনের মানুষ জাবেদের ছোট বেলায় বিয়ে ঠিক করা ছিল কাজিন রুমির সাথে। এমন সংবাদ সুমনাকে বিষাদময় করে তোলে।

স্বপ্নের যে মহল মনে মনে গড়েছে সুমনা, সেটা খান খান করে তখনই ভেঙে গেল, যখন একদিন সুমনা জানতে পারে তার জাবেদ সেই কাজিন রুমিকে বউ করে ঘরে তুলেছে পারিবারিক সিদ্ধান্তে। খুব বড় একটা ধাক্কা খেল সুমনা। জাবেদ কেন তাকে স্বপ্ন দেখাল? তার তো বিয়ে ঠিকই করা ছিল রুমির সাথে। তাহলে কেন আর নিজের জীবনের সাথে সুমনাকে জড়াতে গেল?

দিন দিন গোপন ব্যথায় পুড়তে লাগল সুমনা। এরই মধ্যে তার ভাগ্যের চাকাও ঘুরে গেল। জেলা সদরের এক সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামে গান করার সুবাদে এক অডিও কোম্পানির কর্ণধারের কানে লাগল সুমনার গলাটা। প্রোগ্রাম শেষে তিনি সুমনার সাথে আলাপ করলেন। জানালেন তিনি সুমনাকে ক্যাসেট করার একটা সুযোগ দেবেন।

গুলজার আলী আর মরিয়ম বেগম নিষেধ করলেন না। মাস চারেকের ব্যবধানে বাজারে প্রকাশ হলো সুমনার ক্যাসেট। রাতারাতি সে হিট। অল্প দিনে মিডিয়ায় জায়গা পেয়ে গেল। নিভৃত পল্লীর যে মেয়েটি এতদিন পাড়ায় পাড়ায় কোনো অনুষ্ঠান হলে গাইত, আজ তাকে পরিচিত অনেকেই টেলিভিশনে শো করতেও দেখে। খুব সহজে সুমনা দেশের একজন নামি সংগীত শিল্পী হয়ে উঠল। একের পর এক ক্যাসেট রিলিজ হতে থাকে। সুকণ্ঠ দিয়ে সে দেশের মানুষকে কাছে টেনে নেয় দিন দিন।

বড় বড় ঘর থেকে সুমনার বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু গুলজার আলী মেয়েকে রাজি করাতে পারেন না। জাবেদ সুমনাকে যে আঘাত দিয়ে গেল, সে আঘাতের ক্ষত ভালো না হওয়া পর্যন্ত অন্য কোনো পুরুষকে জীবনের সঙ্গে জড়াতে পারবে না সুমনা। কিন্তু সে অদৃশ্য ক্ষত কবে শুকাবে, কে জানে!

এক সময় গ্রাম ছেড়ে শহরবাসী হয় সুমনারা। শিল্পী জীবন তাকে শহরবাসী করে তোলে। দেশ-বিদেশে প্রচুর প্রোগ্রাম করে অনেক টাকা আয় করে সুমনা একসময় শহরের অভিজাত এলাকায় বাড়ি গড়ে। গুলজার আলী আর মরিয়ম বেগমের সুদিন আসে। গাঁয়ের ভাঙা ঘর থেকে শহরের অভিজাত বাড়িতে ঠাঁই হয় তাদের।

দিন চলে যায়। বয়স বাড়ে সুমনার। বিয়ের বয়সটা পার হতে থাকে। বাবা-মা উদ্বিগ্ন হন মেয়েকে বিয়ে দিতে। কিন্তু সুমনাকে রাজি করানো যায় না। শিল্পী জীবন তাকে দিন-রাত ব্যস্ততার মাঝে রাখে। আজ এখানে তো কাল সেখানে শো নিয়ে সময় কাটে। গানে গানে পার হয় প্রতিটি দিন। জেলা থেকে জেলা আর দেশ থেকে বিদেশ সফর সবই যেন তার একই সুতোয় গাঁথা।

এই তো সেদিন। গুলশান ক্লাবে শো হবে সুমনার। একক সংগীতানুষ্ঠান। সন্ধ্যার পর পরই আয়োজন শুরু। অপেক্ষমাণ মিউজিশিয়ানদের সামনে সুমনা এসে দাঁড়াতেই বিপুল করতালি পড়ে গেল। এত দর্শক দেখে মুগ্ধ সুমনা। মানুষ তার গান এত পছন্দ করে!

হঠাৎ দর্শক সারিতে এক দম্পতিকে দেখে চমকে উঠল সুমনা। ভদ্র লোককে চেনা চেনা লাগছে। হ্যাঁ, ওই তো জাবেদ। পাশে তার স্ত্রী। গর্জিয়াস সাজগোছে বসে আছে জাবেদের বাম পাশে।

অতীত চোখে ভেসে উঠল। এই সেই জাবেদ। যার জন্য আজ সুমনা নিঃসঙ্গ একাকী। ভালোবাসার স্বপ্ন দেখিয়ে এক সময় সে হারিয়ে গেছে সুমনার জীবন থেকে। যে মানুষটি তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, তার প্রিয় গান আজ আবার তার সামনে গাইবে সুমনা। কিছুক্ষণ আগেও সুমনা বিষটি ভাবেনি।

বাদকরা বাদ্য বাজাচ্ছে। তানপুরা, তবলা, সেতারের সুরে দর্শক মনে ফাগুন বয়ে যাওয়ার আগেই সুমনা গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করল-‘ভ্রমর কইও গিয়া, শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে-এ-এ-এ...।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist