হাফিজ উদ্দীন আহমদ

  ০৩ জুলাই, ২০২০

ভ্রমণ

লেডি গডিভার ভাস্কর্য

বার্মিংহামে আর যাওয়া হলো কই? বেলা ১১টার কিছু আগে রাজ্জাক এসে বলল, সে খুব টায়ার্ড, তাই বার্মিংহাম যাবে না। সেখানে যেতে নাকি ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা সময় লাগে। এতক্ষণ সে ড্রাইভ করতে পারবে না। মনটা বিমর্ষ হয়ে গেল। পরক্ষণেই হৃদয়ের যে ঘুড়িটা গুত্তা খেয়ে নিচে নেমেছিল, তা সাঁই করে ওপরে উঠে গেল। এবার জানালো, আমাকে নিয়ে বিকল্প হিসেবে মেইডস্টোন শহরে নিয়ে যাবে সে। মেইডস্টোন লন্ডন থেকে ৩২ মাইল দূরে কেন্টের একটি ঐতিহাসিক শহর। শহরের মাঝ দিয়ে মিডওয়ে নদী বয়ে গেছে। কেন্ট শহর থেকে দূরত্ব প্রায় ১১ কিলোমিটার। শহরটার নাম আগে শুনেছি। রাজ্জাক জানালো, সেখানে একটি বিখ্যাত সামরিক জাদুঘর আছে। শোনার পরই যাওয়ার উৎসাহ দ্বিগুণ হয়ে গেল।

শহর ছাড়াতেই ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ের মাঝ দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম আমরা। শহরটা ছোট তবে সুন্দর, ছিমছাম। রাস্তা খুব প্রশস্ত নয়, দোকানগুলো গোছানো। ঝকঝকে তকতকে চারদিক। সেন্ট ফেইথ স্ট্রিটে যে এলাকায় জাদুঘর, তার কাছাকাছি এসে একটা খোলা মাঠে গাড়ি পার্কিং করে নামলাম।

মিউজিয়াম ফ্রি। বাইরে লেখা : মেইডস্টোন মিউজিয়াম অ্যান্ড বেন্টলিফ আর্ট গ্যালারি। প্রবেশ করতে কোনো টিকিট লাগে না। মঙ্গলবার থেকে শনিবার সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা আর রোববার ১২টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে। ১৮৫৮ সালে এটা স্থাপিত হয়েছিল। প্রাচীন মমি থেকে সামুরাইদের বর্ম, প্রাগৈতিহাসিক যুদ্ধাস্ত্র, আর্ট গ্যালারিতে ২৫০০ হাতে আঁকা ছবি, ৫৭৪টা তৈলচিত্র ইত্যাদি কত কিছুই না আছে এখানে। রিসিপশনের কাউন্টারে কিছু ফ্রি বুকলেট ও বিক্রয়ের জন্য কিছু পুস্তিকা রাখা।

ভেতরে কাচের শোকেসে সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে বস্তুটি রয়েছে তা হলো, ক্রিস্টপূর্ব ৭০০-৬৫০ সনের একটি মমি। সে ছিল ওসিরিসের দ্বার রক্ষকের মেয়ে টাকাশ। এরপর যে কক্ষটিতে এলাম, সেখানে দারুণ রাজকীয় ভাব। মেঝেতে লাল কার্পেট পাতা। পেছনে লাল পটভূমিকায় লেখা : কুইন্স ওউন রয়াল ওয়েস্ট কেন্ট রেজিমেন্টাল মিউজিয়াম। তার নিচে বোর্ডে এই বাহিনীর কর্মকান্ড সম্পর্কিত অসংখ্য ফটো সেঁটে রাখা হয়েছে। অদূরে শোভা পাচ্ছে সাজিয়ে রাখা একটি বিশাল কামান। যুদ্ধজয় করে স্মারক হিসেবে প্রতিপক্ষের কামান নিয়ে আসার ঘটনা ইতিহাসে বিরল নয়। অহম রাজকে পরাজিত করে সুবাদার মির জুমলা আসাম থেকে কামান বয়ে নিয়ে এসেছিলেন এ দেশে, যা আজও তার সে গৌরবগাথা বহন করে বেড়াচ্ছে ঢাকার ওসমানী উদ্যানে। এটাও তেমনি। শিখ যুদ্ধে (১৮৪৫-৪৬) ইংরেজ বাহিনীর ৫০তম সাটলেজ রেজিমেন্ট রঞ্জিৎ সিংহের এ কামানটি দখল করে। যুদ্ধের স্মারক হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তা মহারানী ভিক্টরিয়াকে উপহার দেয়। কামানটি অলংকৃত। নল ব্রোঞ্জে তৈরি। নলের সম্মুখভাগ হিংস্র ব্যাঘ্র মুখের আদলে নির্মিত। পাশে বড় করে সতর্ক বাণী : প্লিজ ডোন্ট টাচ। দেয়ালে টানানো বাহিনীর পতাকা। সাজিয়ে রাখা আছে তাকের ওপর বাদকদলের ঢোল, গৌরবের স্মারক শিল্ড ইত্যাদি। দেয়ালঘেঁষে রাখা কাচের শোকেসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জেনারেলদের লাল রঙের জাঁকজমকপূর্ণ সামরিক পোশাক। তাতে সাঁটা বিভিন্ন সামরিক তকমা। ১৭০০ শতকে তৈরি এ বাহিনী অর্জিত মেডেলগুলো একটু দূরে প্রদর্শন করা। যুদ্ধের সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব চারটি ভিক্টোরিয়া ক্রস পেয়েছিল এ রেজিমেন্ট। বিপরীত দিকে শোকেসের ওপরে দাঁড় করিয়ে রাখা আছে মধ্যযুগের যুদ্ধাস্ত্রের বিবর্তন তলোয়ার থেকে রাইফেল। আর নিচে শোকেসের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইউনিফর্মধারী ব্রিটিশ সৈন্যের মূর্তি। সেখানে বিস্তারিতভাবে বার্মা, ফ্রান্স, উত্তর আলাস্কা, সিসিলি, মাল্টা ইত্যাদি পৃথিবীর নানা স্থানে কেন্ট রেজিমেন্টের বীরত্ব কাহিনি বর্ণনা করা। জাপানি পতাকাও সাজানো কক্ষটিতে। একটি পোস্টারে দেখতে পাচ্ছি, ভারতের কোহিমাতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানি সৈন্যের সঙ্গে ব্রিটিশদের মোকাবিলার কাহিনি। যুদ্ধবন্দিদের বিবরণীও দেওয়া আর এক পোস্টারে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে শত্রুর বিষাক্ত গ্যাস থেকে বাঁচতে এআরপি বা এয়ার রেইড প্রিকুয়েশনের সদস্যরা যে গ্যাস মাস্ক ব্যবহার করতেন, তা রাখা একখানে। লাল রঙের একটা ছোট বাষ্পীয় ইঞ্জিন অদূরে।

পাশের একটি কক্ষে প্রবেশ করলাম এবার। সেখানে রাখা প্রাগৈতিহাসিক যুগের পাথরের কুড়াল, চাকু ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র। আরেক জায়গায় আছে খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ শতকের লৌহযুগের গহনা : লোহার চুড়ি, ব্রেসলেট এবং নাম না জানা কিছু অলংকার। রয়েছে হরিণের শিং, হাড় ও ব্রোঞ্জের পিন। ওপর এক স্থানে নানা ধরনের ১১-১৩ শতকের কিছু মৃৎপাত্র রাখা। ডাইনোসরের গ্যালারিতে পেলাম তার সত্যিকার হাড়, চোয়ালের অংশ। বাইরে ঝোপের মাঝে এই অতিকায় প্রাণীর একটি মূর্তিও চোখে পড়ছে। পাশে আবার কেন্ট রেজিমেন্টের সৈন্যের মূর্তিও রয়েছে।

নেপোলিয়ান বোনাপার্টের নাম শোনেনি এমন কোনো শিক্ষিত লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিশ্ব বিখ্যাত আলেকজান্ডারের পর তিনিই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সেনাপতি। ফরাসি বিপ্লবের সময় তার উত্থান শুরু হয় এবং সিংহাসন দখল করে প্রায় সমগ্র ইউরোপ তিনি পদানত করেন। তার আক্রমণে একসময় ব্রিটেন থর থর করে কেঁপেছে। ওয়াটারলুর যুদ্ধে হেরে অবশেষে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে বন্দি অবস্থায় ১৮২১ সালে মাত্র ৫১ বয়সে প্রাণ ত্যাগ করেন। সেই বিখ্যাত বীরের চেয়ার দেখি কাচের বাক্সে আমার সামনে। নেপোলিয়ানের কাছ থেকে যুদ্ধের সময় কামান কেড়ে নেওয়া সহজ ছিল না, তাই তিনি মরে যাওয়ার পর চেয়ারটাকে বন্দি করে গৌরব করছে ইংরেজ জাতি। পাশেই অপর একটি শোকেসে লাল গদি ও হাতলযুক্ত চেয়ার, যার পৃষ্ঠদেশে হেলান দেওয়ার জায়গাজুড়ে অ্যাম্বোসিং করে রাজকীয় মনোগ্রাম। সম্ভবত এটা ছিল ব্রিটিশ সম্রাটের সিংহাসন। কোনো পরিচিতি লেখা নেই। অদূরে সম্রাট অষ্টম হেনরি যে চেয়ারে বসতেন, সেটাও সযতেœ রাখা। অপর এক কক্ষে প্রাচীন যুদ্ধের লৌহ নির্মিত বর্ম। আপাদমস্তক ঢাকা এ রকম বর্ম পরে নড়াচড়াই তো দায়, সেটা গায়ে কী করে তারা তলোয়ার হাতে লড়াইয়ের ময়দানে ছুটে বেড়াত, কল্পনাই করা যায় না। এ রকম বর্ম আমি ছাত্রজীবনে দেখেছিলাম দিঘাপতিয়ার রানীভবানীর বাড়িতে।

আর্ট গ্যালারিতে পা দিলাম এবার। সেখানে রোমান যুগের অনেক ভাস্কর্য। শোকেসে আবদ্ধ কচ্ছপ-শেয়াল-পেঁচা-ঈগল থেকে শুরু করে নানা ধরনের দুর্লভ পশুপাখির মমি। এত চমৎকারভাবে সংরক্ষণ করা যে, জীবন্ত বলে ভুল হয়। হাজারে হাজারে তৈল ও অন্যান্য শিল্পচিত্র তো আছেই। আমাকে আকর্ষণ করল হজরত নূহ (আ.)-এর নৌকার হাতে আঁকা কল্পিত চিত্র। বুঝলাম যেহেতু বাইবেলে ঘটনাটা উল্লেখ আছে, সেজন্যই এ ছবি মর্যাদার সঙ্গে শোভা পাচ্ছে এখানে। সবচেয়ে দৃষ্টিকাড়া যে প্রদর্শনীটি রয়েছে তা হলো, ঘোড়ার ওপর বসা এক সুন্দরী নারীর নগ্ন মার্বেল মূর্তি। প্রথমে ভেবেছিলাম, ইউরোপীয় শিল্পীদের নগ্নতা প্রিয়তার স্মারক এটা। কিন্তু আসল ব্যাপারটা জানতে পেরে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বিভিন্ন গির্জার পৃষ্ঠপোষক এই মহৎ অ্যাংলোস্যাক্সোন মহিলাটি লেডি গডিভা। নিষ্ঠুর শাসক আর্ল অব মার্সিয়া লিওফ্রিক কোভেনট্রির অধিবাসীদের ওপর অসহনীয় কর আরোপ করলে গডিভা বারবার তা মওকুফ করার জন্য আর্লের কাছে কাতর নিবেদন করেন। আর্ল একটি শর্তে তা মাফ করতে রাজি হন, সুন্দরী গডিভাকে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে সারা শহরে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে আসতে হবে। দুঃখের ব্যাপার, আর্ল আবার সম্পর্কে নাকি মহিলার স্বামী ছিলেন। ১৮৬১ সালে এ ভাস্কর্যটি তৈরি করা হয় আর ঘটনাটি ঘটেছিল ১০৬৭ সালে বা কিছু আগে।

এখান থেকে বের হয়ে একটি ছোট হলঘর পেলাম। প্রবেশ দ্বারের ওপর বড় অক্ষরে লেখা : ড্রেসিংরুম। পৃথিবীতে কোথাও এ রকম ফ্যাশন জাদুঘর আছে জানা ছিল না, তাই বেশ আগ্রহ জাগল। সামনেই ভূমি থেকে ছাদ ছোঁয়া রঙিন বাঁধানো পোস্টার। নগ্ন নারীর ছবি দিয়ে পাশে উৎকীর্ণ : ১৮০০-২০০০। অর্থাৎ ১৮০০ সাল থেকে হাল নাগাদ নারীদের পোশাকে যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে, তা তুলে ধরা হয়েছে এখানে। সঙ্গে মন্তব্য করা উইমেন্স চেঞ্জিং শেপ। আসলে নারীদের আকার পরিবর্তন হয়নি, রুচির পরিবর্তন হয়েছে বলেই ফ্যাশন সৃষ্টি হয়েছে। ভেতরে মহিলা ও শিশুদের রকমারি জামায় সাজানো। বিভিন্ন সময়ে মেয়েদের গাউন, অন্তর্বাস, টুপি, উলের পোশাক, পুতুলের জামা, বল নাচের সজ্জা, ১৮২০ সালের সিল্কের জামা, ভিক্টোরিয়া আমলের পোশাক, বর্তমানের পোশাকি ধাঁচ, টপস, হাতব্যাগ ইত্যাদি কত কিছুই না টানিয়ে রাখা। আমি পুরুষ, তাই দ্রুত এক চক্কর দিয়ে বের হয়ে আসলাম। সঙ্গে মহিলা থাকলে এটা নিশ্চয়ই সম্ভব হতো না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close